গত পর্বে একজন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম যুবক হিসেবে কি ধরণের উদ্যোগ নেয়া যায় সে বিষয়ে কিছু আইডিয়া দেয়া হয়েছে। এবার আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
আর্থিকভাবে আমাদের অবদান কি হতে পারে এরকম শিরোনামে কিছুদিন আগে একটা লেখায় কিছু ধারণা দিয়েছিলাম। আজকের লেখাটাও সেখান থেকেই নেয়া অনেকটা।
আমাদের নিজস্ব কিছু সার্কেল থাকে। আমরা যে এলাকায় বড় হই, সেখানে আমাদের এক পরিচিত সার্কেল গড়ে উঠে। সার্কেল বলতে আমি এক ক্লাসে পড়েছি শুধু এরকম বন্ধু/ক্লাসমেটদের বুঝাচ্ছি না। বরং উঠা বসার কারণে মোটামুটি একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এরকম গ্রুপকে বুঝাচ্ছি। অনলাইনের গ্রুপের সাথে এর পার্থক্য হল অনলাইনের সম্পর্কগুলো অনেক সময় অবিশ্বাস আর সন্দেহের আক্রমণের স্বীকার হয়। ফলে একটু চাপ আসতেই ভেঙ্গে পড়ে। এই সার্কেলগুলোর উৎপত্তি বাস্তব জীবনের উঠাবসার মাধ্যমে হয় বলে নিজেদের মধ্যে মোটামুটি একটা বুঝ গড়ে উঠে এবং স্থায়িত্ব বেশী হয়। তো এরকম সার্কেল হতে পারে এলাকা কেন্দ্রিক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক, কিংবা চাকরি/ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যমে তৈরি হওয়া অথবা একেবারে বিশুদ্ধ অনলাইন সার্কেল।
তো এসব সার্কেলের মধ্যে আমরা জানি কাদের মাঝে ইসলামের জন্য কিছু একটা করতে হবে এরকম বুঝ আছে বা তৈরি হবার সম্ভাবনা আছে কিংবা একটা টান আছে। হয়ত তারা নিজেরা সময় দিতে পারছে না, কিংবা কোন এক জুজুর ভয়ে নিজেরা একটিভলি কোন ধরণের কথা বলতে পারছে না বা আর্থিকভাবে নিজেরা কোন প্রতিষ্ঠানে বা কাজে যুক্ত হতে পারছে না। কিন্তু আমাদের সহযোগিতায় তারা আর্থিকভাবে এধরণের প্রজেক্টে অবদান রাখতে ইচ্ছুক।
তাহলে একটি সার্কেলের কয়েকজন মিলে আমরা একটা ছোট গ্রুপ তৈরি করতেই পারি যারা প্রতি মাসে অথবা একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর একটা নির্দিষ্ট চাঁদা দিয়ে একটা ফান্ড তৈরি করতে পারি। চাঁদার পরিমাণ সমান হতে হবে ব্যাপারটা এমন না। যে যার সামর্থ্যের মধ্য থেকে যতটুকু পারে একটা পরিমাণ ঠিক করে অবদান রাখল।
একজন ব্যক্তির এরকম কয়েকটা সার্কেলে তাহলে কয়েকটা ফান্ড তৈরি হল। এসব ফান্ডের ম্যানেজমেন্ট এর জন্য একজনকে দায়িত্ব দেয়া যায়। এখানে বলে রাখা ভাল, এখানে অবশ্যই নিজেদের মধ্যে একটা বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপার রয়েছে, কারণ আগেই বলেছি এই ফান্ডগুলো তৈরি হবে নিজেদের সার্কেলের মধ্যে। আর এগুলোর প্রকৃত উদ্দেশ্য হল আল্লাহর তাআলার দ্বীন প্রচারে ব্যয় করা যার মধ্যে বেশীরভাগই হবে সদকায়ে জারিয়া। তো এখানে কেউ নিজ স্বার্থ নয়, বরং দ্বীনের স্বার্থে কাজ করছে।
ফান্ড ম্যানেজিং বলতে বুঝাচ্ছি মাসশেষে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়া, হিসাব রাখা এসব। একজন দায়িত্ব নিতে না চাইলে সবাই মিলে রোটেশন ভিত্তিতে একজন একজন করে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
এখানে বলে রাখা ভালো, এই ফান্ডে হাজার হাজার টাকা রাখতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। একজন ছাত্র চাইলেই পঞ্চাশ টাকা মাসে জমা রেখে দুই তিনজন মিলে একটা ফান্ড গঠন করতে পারে। এখানে আনুষ্ঠানিকতার কিছু নেই, প্রচার প্রচারণার কিছু নেই। বেশীরভাগ দান তারা গোপনেই করবে, একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য।
ফান্ডের অর্থ কিভাবে ব্যয় হবে? ব্যয় করা অনেক সহজ। বর্তমানে অনেক ভালো ভালো অর্গানাইজেশন কাজ করছে, এর একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন। উনাদের কাজের ক্ষেত্র অনেক বড়। তো এরকম অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা এসব ফান্ড এর অর্থ সতর্কতার সাথে অনেক ভালোভাবে ব্যয় করে থাকে। এছাড়া আমাদের নিজেদের চারপাশে অনেক দ্বীনি প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানেও আমরা এর অর্থ ব্যয় করতে পারি।
অর্থ ব্যয় কিভাবে করা হবে এর জন্য মাসে/তিন মাসে একবার করে অনলাইনে/অফলাইনে বসে পলিসি ঠিক করা হবে। নিজেরা মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ফান্ডের অর্থ যাবে। ফান্ড ম্যানেজার সে অনুসারে পলিসি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত ব্যয় করবে এবং প্রতি মাসে আয় ব্যায়ের হিসাব পেশ করবে। হিসাব হতে হবে স্বচ্ছ।
প্রশ্ন করতেই পারেন, আমি তো নিজেই দান করছি, নিজে একা একাই তো এসব কাজ করতে পারি। ফান্ড কেন গঠন করতে হবে?
এখানেই আমার মূল পয়েন্ট। নিজে একা তো দান করবেনই, কিন্তু একা একা সবসময় কমিটমেন্ট রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে সময় বের করা যায় না, কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌছানোর সময় হয় না। আস্তে আস্তে আলসেমি তৈরি হয়। শয়তান ভুলিয়ে দিতে থাকে।
একসাথে কয়েকজন মিলে ফান্ড তৈরি করলে কয়েকটি উপকার রয়েছে।
১। একটা ফরমাল এরেঞ্জমেন্ট হবার কারণে একটা বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে।
২। পেশাগত কারণেই হোক, আর অন্য কারণেই হোক আমাদের নিজেদের মধ্যে একটা সময় যোগাযোগ একেবারেই কমে যায়। এই ফান্ডের উপলক্ষ্যে ওই যোগাযোগটা বহাল হবে।
৩। এই সম্পর্কটা তৈরি হবে একেবারে আল্লাহর জন্য। আর আল্লাহর জন্য যে সম্পর্ক তৈরি হয় তার শেষ এই দুনিয়ায় হবে না ইনশাআল্লাহ। আখিরাতে আল্লাহ চাহে তো একজন আরেকজনের জন্য সাক্ষী হবে।
৪। একটা দ্বীনি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।
৫। মাঝে মাঝে বসার কারণে একজন আরেকজনের খোঁজ খবর নিবে, ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে ইনশাআল্লাহ।
৬। এলাকার দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সহযোগিতা পাবে। একই কথা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
৭। এসব প্রতিষ্ঠান মাঝে মাঝে দেখতে যাওয়ার মাধ্যমে এগুলোর সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি হবে।
এভাবে অনেক ফায়দা উল্লেখ করা যায়। সবথেকে বড় কথা হল, এই দানটা সদকায়ে জারিয়া হবে। এর সওয়াব কিয়ামত পর্যন্ত আসতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
এই ফান্ডগুলো আমার পূর্বে উল্লেখিত কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভাবে সাপোর্ট দিবে। কিভাবে? সেটা পরের লেখায়।