স্কুল কলেজের শিক্ষায় দ্বীনি উদাসীনতা এবং আমাদের করনীয়-৫

স্কুল কলেজের শিক্ষায় দ্বীনি উদাসীনতা এবং আমাদের করনীয়-৫

যুবকদের বিভিন্ন দ্বীনি সামাজিক শিক্ষামূলক কার্যক্রমের উপরে দৃষ্টিপাত করার আগে সংশ্লিষ্ট কিছু কথা না বললেই নয়। যে কোন কারণেই হোক, নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে সামাজিকভাবে ইসলাম বিদ্বেষ ঢুকে গেছে, এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। 

একটা তরুণ বা যুবকের মধ্যে হঠাত যদি ইসলামী চেতনা জাগ্রত হয় এবং সে যদি বেসিক ফরজ ওয়াজিব সুন্নাহ সম্মত ভাবে পালন করতে চায়, তাহলে সবার আগে তার কাছের মানুষগুলো থেকে তাকে অনেক সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়। 

পরিবার ভয় পেতে থাকে, সমাজে কানাঘুষা চলতে থাকে। সন্দেহ, অবিশ্বাস, হাসি ঠাট্টা ইত্যাদি ঠেলে অনেকেই আর এগোতে পারে না। ফিরে যায় চিরাচরিত জীবনে। 

এরকম পরিস্থিতিতে কিছু যুবক, বিশেষভাবে দ্বীনি চেতনাধারী কিছু যুবক যদি সামাজিক বা শিক্ষামূলক কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়, তাদেরকে সামাজিকভাবে, এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও অনেক সন্দেহ, সংশয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, এটা আর বলতে হবে না। অন্তত তাদের সন্দেহ দূর করতেও সময় দিতে হবে, তাদের বুঝাতে হবে, এর জন্য এক বিশেষ ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে, আরো না জানা কত চ্যালেঞ্জ যে মোকাবিলা করতে হবে আল্লাহই জানে। 

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হয়। একবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করছে। ইজ -*রায়েল নামে এক বিষফোঁড়া তৈরি করে দিয়েছে। আরেকদিকে তারাই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও মুসলিমদের পরাস্ত করার পাঁয়তারায় লিপ্ত এবং এ বিষয়ে তারা অনেকটাই সফল। আজ মুসলিম যুবকেরা তাদের দেখানো পথে জীবন উপভোগের চিন্তায় বিভোর, মুসলিম শাসকেরাও তাদের দেখানো পথেই দেশ চালনার চিন্তায় লিপ্ত। 

এই পরিস্থিতিতে একজন মুসলিম যুবকের রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অনেক ফ্রন্টে অনেক কিছু করার থাকে, অনেক ফ্রন্টে তার এক্টিভিটি থাকাটা স্বাভাবিক, যেহেতু কিছু করতে চাওয়া যুবকের সংখ্যা অনেক কম। কিন্তু তারা যখন সামাজিক শিক্ষামূলক কোন কার্যক্রম করতে যাবে, তাদেরকে বৃহত্তর স্বার্থে এই কার্যক্রমকে তার অন্য যেকোন পরিচয় থেকে মুক্ত রাখতে হবে, তার নিজস্ব স্বার্থ, রাজনৈতিক কোন স্বার্থ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তাহলেই এটা একটা সামাজিক শিক্ষামূলক আন্দোলন হিসেবে রুপ লাভ করতে পারবে। অন্যথায় নিজের অন্যান্য পরিচয়ের সাথে এটা মিলে গিয়ে পুরো বিষয়টার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে।

অর্থাৎ আমাদেরকে জায়েজের সীমায় থেকে এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ও অডিয়েন্সের কথা মাথায় রেখে উদারতা অবলম্বন করতে হবে। সাথে ধৈর্য রাখতে হবে, সময় দিতে হবে, অর্থ দিতে হবে। সাহস রাখতে হবে, আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। 

এবার মূল কথায় আসি। আসলে কার্যক্রমগুলো হবে অনেক সাধারণ। কিন্ত উদ্যোগ, সদিচ্ছা এবং আমাদের সহযোগিতামূলক মানসিকতার অভাবে এই কাজগুলোই কেউ নেয় না। 

আমাদের এলাকাভিত্তিক বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কিছু পরিচিত ভাই মিলে অনলাইন বা অফলাইন প্লাটফর্ম যেমন- ইউথ ফোরাম/ক্লাব ইত্যাদি তৈরি করবেন। তারা অন্ততপক্ষে এইচএসসি পাশ হতে হবে। অনানুষ্ঠানিক হতে পারে, আবার সংগঠিত কোন প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। আগের একটি লেখায় এর কার্যক্রমগুলো উল্লেখ করেছিলাম। নিচে আবারো উল্লেখ করলাম। বাধ্যতামূলক কিছু না, কেবল রেফারেন্সের জন্য। 

১। তারা এলাকার সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ খবর নিবে। প্রতিষ্ঠানগুলো হতে পারে প্রচলিত দ্বীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা প্রচলিত স্কুল, কলেজ। অথবা হতে পারে অনানুষ্ঠানিক মক্তব কিংবা মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা কার্যক্রম। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখবে, তাদের সাথে সৌজন্যতা বজায় রাখবে জায়েজের সীমায় থেকে।

২। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কিংবা এলাকাভিত্তিক যুবক ও তরুণদের সচেতন করার জন্য তারা সেমিনার আয়োজন করবে। বর্তমানের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- জুয়া, মাদক, অশ্লীলতা ইত্যাদি কিংবা আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন ধ্যান ধারণা – ট্রানস গন্ডার মতবাদ, পর্নোগ্রা ফি, অবৈধ প্রেম, বিভিন্ন ইজম সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রেজেন্টেশন বা বক্তৃতা দিবে। তারা যদি নিজেরা না পারে তবে এ বিষয়ে জন্য কোন এক্সপার্ট ভাইকে অতিথি হিসেবে ডেকে নিবে। 

৩। উপরের একই ধরণের আয়োজন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের উদ্দেশ্যেও হতে পারে। সেক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিত্তিতে এ ধরণের আয়োজন হতে পারে। এ ধরণের আয়োজনে ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে হতে পারে। 

৪। এখন দেখি অনলাইনে অনেকেই ইসলামের ইতিহাস, সীরাত ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে অনেক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। অফলাইনে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক, সামর্থ্য থাকলে এলাকাভিত্তিক এ ধরণের আয়োজন করবে তারা। এতে এই বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়বে। এই আয়োজনকে উপলক্ষ্য করে কম মূল্যে ছোট কিছু বই বিতরণ করা যেতে পারে। এছাড়া উপহার হিসেবে এসব বিষয়ের বই বিতরণ করা যেতে পারে। 

৫। তারা এলাকার মক্তব শিক্ষাকে শক্তিশালী করার জন্য সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে স্কুলের পূর্বে, স্কুলের পরে অল্প সময়ের জন্য মক্তব এর প্রচলন করার জন্য শিক্ষক, অভিভাবক, পরিচালনা কমিটি , আলেম উলামাদেরকে সচেতন করার জন্য তারা কাজ করবে।

৬। পরিচালনা কমিটি ও আলেমদের সহযোগিতায় মসজিদ্ভিত্তিক বিভিন্ন প্রোগ্রাম হাতে নিবে, এই প্রোগ্রামে ছাত্র, যুবকদের দাওয়াত দিবে। অল্প সময়ে কার্যকরী নসিহত মূলক হতে পারে। এছাড়া মসজিদভিত্তিক বা অন্যান্য বয়স্ক দ্বীন শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। মানসম্মত ইসলামিক স্কুল বানানোর জন্যও চেষ্টা করবে। 

৭। এলাকার শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার বিষয়ক পরামর্শ দিবে, মাঝেমাঝে এ বিষয়ে সেমিনার করবে। বাহিরে কোন সহযোগিতা প্রয়োজন হলে তা করার চেষ্টা করবে। এছাড়া বই বিতরণ, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি সামাজিক কাজ করবে তারা। 

এরকম আরো অনেক কাজ হতে পারে। যেগুলো তারা নিজেরাই খুঁজে বের করতে পারবে। এখন দেখা যাক তাদের কি কি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।

১। এটি হবে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্লাটফর্ম। তা কোন গোষ্ঠী, দল বা সংগঠনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে না।

২। প্লাটফর্মের আর্থিক হিসাবাদিতে স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এগুলো হল দ্বীনি প্লাটফর্ম, এখানে আর্থিক অনিয়ম দ্বীনের বড় ধরণের ক্ষতি করে ফেলতে পারে যেটা আমাদের কাম্য না। 

৩। প্লাটফর্মের সদস্যরা অন্তত বেসিক ইসলামি ফরজ ওয়াজিব পালনের প্রতি যত্নবান হবে।

৪। প্লাটফর্মের সদস্যরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদা সম্পন্ন হবে, তবে আকিদা ও মাজহাবগত প্রান্তিকতা পরিহার করতে হবে। এর মানে হল মাজহাবের প্রতি বিদ্বেষ থাকা যাবে না, একই সাথে মাজহাব নিয়ে বাড়াবাড়িও করা যাবে না। এটা আলেমদের প্লাটফর্ম না, তাই এখানে এ বিষয়ে তর্ক বিতর্কের প্রশ্নই ওঠে না। সমাজে ও প্লাটফর্মের ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি যেন না হয় সেদিকে প্রত্যেকে যত্নবান হবে। 

৫। কাজের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সুন্নাহর সাথে করার চেষ্টা করবে।

৬। সব কাজ আলেম উলামাদের পরামর্শে করবে এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে। 

এখন আসি তারা নিজেদের জন্য কি করবে। 

১। প্রতি মাসে একবার হলেও নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসবে। অফলাইনে না হলে, অনলাইনে। মাঝে মাঝে অফলাইনে। নিজেদের মধ্যে কোন মতানৈক্য তৈরি হলে অফলাইনে আলোচলনা করবে। অনলাইনের উপর নির্ভরশীল হবে না। 

২। নিজেদের জন্য ফরজে আইন ইলম শিক্ষার ব্যবস্থা করবে। সম্ভব হলে প্রতিদিন, নাহলে সপ্তাহে একবার, না হলে মাসে একবার অন্তত একজন আলেমের মজলিসে বসবে, দ্বীনি আলোচনা শুনবে। ইলম শিক্ষা করবে। কুরআন পড়া সহীহ করবে। 

৩। সুযোগ হলে তাবলীগ বা অন্য কোন দ্বীনি উদ্যোগের সাথে জুড়বে। নিজের আত্মশুদ্ধিতে মনোযোগী হবে। 

৪। প্রত্যেক কাজ কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তষ্টির জন্যই করবে। 

৫। মাঝে মাঝে কোন দ্বীনি সম্মেলন, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ঘুরে আসবে। এতে নিজের কাজের স্পৃহা বাড়বে।

ইত্যাদি ইত্যাদি।

উপরে কেবলমাত্র ধারণার জন্য কিছু আইডিয়া দেয়া হল। কাজ শুরু হলে ইনশাআল্লাহ ক্রমেই কাজের পরিধি বাড়বে। বলে রাখা ভালো এই কাজগুলো করতে কিন্তু খুব বেশী সময়ের দরকার হবে না। প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছা।

পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। কিছু লিখি। তারপর আবার মুছে ফেলি। লেখা আর মুছে ফেলার মাঝে কিছু থেকে যায়। সেগুলোর জন্যই এখানে আসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top