দুঃস্বপ্ন

দুঃস্বপ্ন

সকালের ইসলাহী মজলিস থেকে ফিরে একটু শুইলাম। আজ শুক্রবার, জুমুয়ার নামাজে যেতে হবে। কখন যে চোখ লেগে এসেছে মনে করতে পারছি না।

শুধু দেখলাম মসজিদ থেকে ফিরছি। হঠাৎ উপরে তাকিয়ে দেখি কি জানি একটা উড়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় বিমান দেখলে আমরা হইচই করে আঙ্গুল তুলে দৌড়াতাম, যতক্ষণ দেখা যায়। মাঝে মাঝে উড়োজাহাজ তার ধোঁয়ার মাধ্যমে স্বাক্ষর রেখে যায়। আমি আজও উপরে তাকালাম দেখি পিছে জেটের মত ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে একটা রকেট ছুটে যাচ্ছে। ধোঁয়ার আরো অনেকগুলো লাইন। তার মানে আগেও গিয়েছে।

একটু পর দেখি একটা বিমানকে রকেটগুলো তাড়া করছে। কিছুক্ষণ পর দেখি অনেকগুলো রকেট সেই দূর দিগন্ত থেকে ছুটে আসছে। আমি দৌড় লাগালাম। কিছুক্ষণ পর একটা বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়ালাম। হঠাৎ দেখলাম বোমাগুলো আছড়ে পড়তে শুরু করল। বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়ানো নিরাপদ বোধ করলাম না। মনে হচ্ছে বোমারু বিমান বোমা ফেলতে ফেলতে যাচ্ছে। সামনের গাছটা হঠাৎ একটু উপর থেকে ভেঙ্গে গেল। পাশে দাঁড়ানো শিশুটার গায়ে পড়তে ধরল। আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।

আযানের শব্দে আমার ঘুম ভাংল। বুক ধকধক করছে। শরীরে এতটুকুও শক্তি নেই। কি দুঃস্বপ্নই না দেখলাম। শুনেছি সকালের স্বপ্ন সত্যি হয়। দুপুরের স্বপ্ন সত্য হবার সম্ভাবনা কতটুকু, জানা নেই আমার।

সকালের মজলিসে হুজুর ইলমের ফযীলত বর্ণণা করছিলেন। ইলম হল নূর। আল্লাহ তায়ালা গুণাহগারকে দেন না। এর জন্য অন্তরকে হিংসা, পাপ ইত্যাদি থেকে পরিষ্কার রাখতে হয়। কখনো কখনো আল্লাহ তায়ালা কাউকে দিতে চাইলে তাকে আগে পরিষ্কার করে নেন।

হুজুর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেন। কেউ এক বোতল কেরোসিন আনতে বলল। যে যাবে সে হাতের কাছে যে বোতলই পাক তাই নিয়ে যাবে। কেরোসিন আনার জন্য অত পরিষ্কার বোতল দরকার হয় না। কিন্তু এক কেজি ঘি আনতে বললে? সে পরিষ্কার বোতল খুঁজবে। না পেলে অপরিষ্কার বোতল ভালো করে ধুয়ে নিবে। সে যদি অপরিষ্কার বোতল নিয়ে দোকানদারের কাছে যায়, দোকানদার ওই বোতলে তাকে ঘি দিবেন না। ভালো দোকানদার হলে বলবে, দেন তো ভাই আমাকে, আমি পরিষ্কার করে দিই।

আল্লাহ তায়ালাও তেমনি তার ইলম যাকে তাকে দেন না। আজ বয়স্ক মাদ্রাসায় যাদের আসার তৌফিক হচ্ছে, কদর না করলে আল্লাহ তায়ালা তা উঠালেও তার কোন ক্ষতি হবে না। হুজুর বয়ান করছেন, আমরা শুনছি। বয়স্ক মাদ্রাসার মাসিক ইসলাহী মজলিস। একটু পর সীরাতের উপর কুইজ হবে, সবাই বেশ জোরেশোরে প্রস্তুতি নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।

আমি এই জায়গাটাকে ভালোবাসি। আমি কোথায় ছিলাম, আল্লাহ তায়ালা আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন। এখানে আমি দীনের প্রতি বিশুদ্ধ দরদওয়ালা মানুষদের দেখি। আলেমদের দেখি। ছাত্রদের দেখি। কিছুদিন আগে ঢাকায় বার্ষিক মজলিসে সবাই গেলেন। আমার যাওয়া হয়নি। পরদিন দুপুরে এক সাথীভাই এর সাথে মসজিদের সামনে দেখা। ষাটোর্ধ মানুষ। দোকানে দোকানে পাউরুটি কেক দিয়ে বেরোন। একটা বেকারী ভ্যান আছে। মাগরিবের পর ভ্যান নিয়ে এসে মাদ্রাসার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এশা পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর আবার ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে যান। রাত এগারোটা পর্যন্ত রুটি বিলি করেন। উনাকে আমি ফজরের পরেও দেখি একই কাজ করেন।

যাইহোক আমাকে দেখে এগিয়ে আসলেন। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সালাম দিয়ে বললেন, পরশু রাত বারোটা পর্যন্ত পাউরুটি দিয়ে বেরোলাম। রাতের ট্রেনে রওনা দিলাম। সকাল সাতটায় পৌঁছলাম। বিকেলে বয়ান শেষে বাসে করে চলে আসলাম। একদিন আমার হাজার খানেক টাকা লস হয়েছে। তবুও আলহামদুলিল্লাহ।

আমি মাঝে মাঝে উনাদেরকে নিয়ে ভাবি। উনি এক হাজার টাকা নগদ লস করেছেন। আরো এক হাজার যেতে আসতে ব্যয় করেছেন। এই বয়সে টানা এরকম জার্নি করেছেন। কিসের লোভে? কিসের আশায়? মাঝে মাঝেই উনাকে দেখতাম মাদ্রাসার বিল্ডিঙয়ের জন্য এর ওর কাছ থেকে টাকা এনে দিচ্ছেন। নিজের নাই তো কি হয়েছে। যাই হোক এসব ভিন্ন আলাপ।

প্রতিযোগিতা শেষে মুহতামিম হুজুর উঠে দাঁড়ালেন। দিলে বড় ব্যথা নিয়ে বেশ কিছু কথা বললেন। বেশ জোরেশোরেই বড় আক্ষেপ থেকেই বললেন, আমরা চাইলে আপনাদের মত, অন্যদের মত হয়ত টাকা কামাইয়ের পিছনে ছুটতে পারতাম। কিন্তু তাতে দীনের এ কাজগুলো কে করত? দীন তো তাতে আগেই শেষ হয়ে যেত। আজ দুনিয়াবি সামান্য ফায়দার জন্য মানুষ কোটি কোটি টাকা খরচ করতে দ্বিধাবোধ করে না। একজন ভিক্ষুক হাত পাতলে বিরক্ত হয়। দীনের জন্য একশ দুইশ টাকা খরচ করতে চায় না।

আমি বয়ান শুনি। দিলে এসে লাগে। দীনের জন্য আমাদের দরদ কোথায়? উম্মাহর জন্য আমাদের দরদ কোথায়? আজ গাজাবাসীর প্রতিদিনের আর্তনাদ আমাদের সামনে আসে। আমরা সেখানে এক সেকেন্ড ব্যয় করতে চাই না। স্ক্রোল করে এগিয়ে যাই। যে শেয়ার দিছে তার প্রতি বিরক্ত হই। এক জিনিস দেখতে আর কত ভালো লাগে?

অথচ আজ আমরা যে শান্তির মধ্যে আছি কাল আমাদের অবস্থা যে তাদের মত হবে না সেটার নিশ্চয়তা কতটুকু? আজ তাদের দখলদার প্রতিবেশী তাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশীর মধ্যে যে পরিমাণ বিদ্বেষ আমাদের প্রতি তারা লালন করে তা জায়োদের থেকে কতটুকুই বা কম! আজ আমাদের পাশের দেশে মুসলিম পরিচয়ের কারণে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, সেখানে হাজার হাজার মসজিদ মাদ্রাসা ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে তা কি আমাদের নজরে আসে? আমাদের আরেক পাশে আমাদেরই মুসলিম ভাইদের বৌদ্ধরা জালিয়ে পুড়িয়ে দিল, আমরা তাদের প্রতি কতটুকু দরদ অনুভব করেছি?

আজ আমরা পশ্চিমা আব্বুদের তেলায়ে তেলায়ে চলছি, যাদের পেটের ভেতর বসে আছি তারা যদি কাল এটাক করে কে এগিয়ে আসবে আমাদের জন্য? আমাদের মধ্যে আজ ঈমানের আলামত হারিয়ে যেতে বসেছে, আমরা ইসলামের শিআর বা নিদর্শনগুলো হারিয়ে ফেলতে বসেছি। আজ আমাদের বাহিনীগুলোতে দাঁড়ি রাখতে অনুমতি লাগে, হাঁটুর নিচে একটু বড় করে কাপড় পড়লেই জঙ্গি তকমা পেয়ে যায়।

আমি জিওপলিটিক্স বুঝি না। আমি শুধু বুঝি আমাদের প্রস্তুতি লাগবে। আমাদের ঈমানের মজবুতি লাগবে, আমাদের দীনের জন্য এগিয়ে আসা লাগবে, উম্মাহর জন্য দরদ লাগবে, বুকে ব্যথা লাগবে, তাহাজ্জুদের চোখের পানি লাগবে, ইলম ও আমল লাগবে। হুজুর বললেন, যার সম্পদ আছে, সে সম্পদ দিয়ে এগিয়ে আসেন, যার মেধা ও শ্রম আছে সে তাই নিয়ে এগিয়ে আসেন। সম্পদ কামাই করেন, দীনের জন্য ব্যয় করেন। এটা সাহাবীদের সুন্নাহ। তাদের নিজেদের সম্পদ নেই, তো কি হয়েছে, বাজারে গিয়ে মজুরি দিয়ে অর্থ আয় করে সেই আয় দীনের জন্য ব্যয় করেছেন। আজ আমাদের সেই তামান্না কই?

সকালের সেই মজলিসের কথাগুলো আমার কানে ঝনঝন করে বাজে। এই দুঃস্বপ্ন দেখে হাঁসফাঁস করতে করতে আমার চোখে ভাসে আমার সেই দরদ কই? দিনগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, রাতগুলো নির্জনে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই দিনের, সেই রাতের হক আদায় করার মানসিকতা কই?

আজ আমরা সুস্থ আছি, আজ আমাদের সময় আছে। যেদিন আমাদের সময় থাকবে না, যেদিন আমাদের উপর বোম এসে পড়বে, যেদিন আমাদের উপর কিয়ামত নেমে আসবে, কিংবা যেদিন আমাদের সময় ফুরিয়ে যাবে, মৃত্যু এসে আমাদের ওপারে পাঠিয়ে দিবে, সেদিনের পর আমরা কিছু করার থাকবে না।

কিছু করার এখনই সময়। আমাদের সম্পদ ব্যয় করার এখনই সময়, আমাদের মেধা কাজে লাগানোর, আমাদের শ্রম দেয়ার। ইলম অর্জনের, হালাল পথে সম্পদ অর্জনের, আমলে কাটানোর। কাল এই দুঃস্বপ্ন বাস্তব হয়ে আসলে, কাল মৃত্যুর ফেরেশতারা আমাদের সামনে চলে আসলে আর ফুরসত মিলবে কি?

আল্লাহ তায়ালা আমাদের অর্থ, মেধা, শ্রম, সময় কাজে লাগানোর তৌফিক দান করুন।

পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। কিছু লিখি। তারপর আবার মুছে ফেলি। লেখা আর মুছে ফেলার মাঝে কিছু থেকে যায়। সেগুলোর জন্যই এখানে আসা।
Back To Top