দুই উস্তাদ আমার সামনে বসে বিল্ডিংয়ে কি কি থাকবে ঠিক করার চেষ্টা করছেন।
আমি সামনে বসে তাদের কথা শুনছি আর উনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। দুজনের চোখেমুখেই আলোর ঝলকানি। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে।
‘দোতলার এই পাশে একটা ছোট রুম লাগবে।’
‘আর সিড়ির নিচে মাল সামানা রাখার জন্য স্টোররুমটা ?।’
‘ওটা তো অবশ্যই।আর লাইব্রেরী রুমের পাশাপাশি একটা মিটিং রুম। মেহমানখানাটা বড় করে বানাতে হবে। সাথে অবশ্যই এটাচথ বাথরুম।’
আমি শুনছি আর দেখছি।
এই তো কদিন আগে। চার বছরের কাছাকাছি। একজন উস্তাদ ঢাকা থেকে আসলেন। ভাড়া একটা বাসায়। কদিন পর মাদরাসা প্রায় উঠে যাওয়ার উপক্রম। তবুও উস্তাদ গল্প শোনান। মাদ্রাসা বড় হবে। ভবন উঠবে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে।
আমি শুনি আর অবিশ্বাসের সাথে মাথা নাড়াই। সংশয়ের সাথে প্রশ্ন করতে থাকি। এত কিছু ভাবতে পারিনা।
চার বছরের মাথায় আলহামদুলিল্লাহ একটা জায়গা হয়েছে। দুইটা ঘর উঠেছে। উস্তাদের সংখ্যা বেড়ে পাচ জনে দাড়িয়েছে। হয়েছে স্কুল শাখাও। কোন কিছুই মাথায় ধরে না।
উস্তাদরা যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে হয়ত এই বাজারে কোনভাবেই চলা সম্ভব নয়। তারপরও নতুন উস্তাদ আগ্রহভরে নেন।
উস্তাদদের চোখেমুখে যে স্বপ্ন আমি দেখি, এ স্বপ্ন আমি অনেককে দেখতে দেখেছি।
খালি জমির সামনে দাড়িয়ে কৃষককে দেখেছি সোনালী ফসলের স্বপ্ন দেখতে।
গরুর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে এই স্বপ্ন দেখতে দেখেছি।
খেলা শুরুর আগে ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেনের চোখেমুখে এই একই স্বপ্ন ছিল। ছিল দশতলা ফাউন্ডেশন দেয়ার দিনে বাড়িওয়ালার মুখে।
এই স্বপ্ন অনেকে দেখলেও কিছু একটা নতুন আছে যেটা অন্য কোথাও দেখিনি।
উস্তাদদের চোখেমুখে যে স্বপ্ন দেখি, তার একটা শিকড় আছে।
এই শিকড় অনেক গভীর।
এই শিকড় আল্লাহর উপর ভরসার, এই শিকড় তাওয়াককুলের।
উনাদের পকেটে টাকা নেই, মাদ্রাসার অনেক ঋণ রয়েছে হয়ত।
তবুও উনারা স্বপ্ন দেখতে পারেন। দেখেন। কারণ এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন তারা নিজেরা করবেন না। তারা আল্লাহ তাআলার উপর সেই ভার ছেড়ে দিয়েছেন।
আমি উনাদের সামনে বসে একটা অদৃশ্য দীক্ষা পাই।
তাওয়াককুলের দীক্ষা, ইলমের দীক্ষা।
এই শিক্ষা, এই দীক্ষা বই পড়ে শিখা যায় না। এই দীক্ষা অনলাইনে পাওয়া যায় না।
এই শিক্ষা, এই দীক্ষা যায় সীনা থেকে সীনায়। বুক থেকে বুকে।
উনারা পেয়েছেন উনাদের উস্তাদ থেকে, তারা তাদের উস্তাদ থেকে। এভাবে এই দীক্ষা গিয়ে মিশেছে খেজুর পাতার ছাউনির সেই মসজিদে নববীতে, রাসূলুল্লাহ থেকে সাহাবীতে।
সমাজের অন্য জায়গায় যে স্বপ্নগুলো দেখি সেগুলো প্রাণহীন। অনেকক্ষেত্রে সেখানে মিশেছে হিংসা, অহংকার, বিদ্বেষ আর হতাশা।
সেই স্বপ্নগুলো এই দুনিয়ার সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না। এই স্বপ্নরা অতিক্রম করে মহাকাল, টিকে থাকে অনন্ত অসীম পর্যন্ত।
আমি স্বপ্ন দেখতে চাই। মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই স্বপ্নগুলোর সাথে জড়িয়ে রাখার তৌফিক দিন। আমিন।