জীবনের প্রয়োজনে

জীবনের প্রয়োজনে

 (বর্তমান প্রেক্ষাপটে জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ সম্পাদন করে লেখা)

খবর সংগ্রহ করতে এরিয়া কমান্ডারের কাছে গিয়েছিলাম সেদিন। নতুন কোন ভিডিও আছে কিনা জানতে। অনেকটা সন্তপর্ণে টানেলের বাঁকটা ঘুরে একটা ফলস দেয়ালের পরে কুঠুরিটা। বেশ কিছুক্ষণ সময় বসলাম। উনি বেশ ব্যস্ত। আমাকে একটা ডায়েরী ধরিয়ে দিলেন। বললেন, এটা পড়তে থাকুন, ইডিট করতে সময় লাগছে।

ডায়েরীটা হাতে নিলাম। মাঝারী আকারের খয়েরি কভারের একটা ডায়েরী। এক কোণায় কিছুটা রক্ত। ধুলো লেগে শুকিয়ে গেছে।

ভেতরে গোটা গোটা হাতে সুন্দর করে লেখা। আমি পড়তে শুরু করলাম।

প্রথম প্রথম টানেলের এই অন্ধকারের মধ্যে ভয় লাগত। মাঝে মধ্যেই ছুটে বের হতাম। মুক্ত বাতাসের জন্য। নীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে দুই হাত মেলে মুক্ত বাতাস টানা। তারপর আবার ফিরে আসতাম। ট্রেনিঙয়ের সময়টাতে করতাম এটা বেশী। এখন সহ্য হয়ে গেছে।

অবশ্য অভিযানের সময় ছাড়া বের হওয়ারও উপায় নেই। আরপিজিটা কাঁধে করে তিন চারজনের গ্রুপ করে বের হতাম আমরা। টানেলের দক্ষিণদিকের মুখ দিয়ে বের হয়ে তাড়াতাড়ি ভাঙ্গা বিল্ডিং গুলোর মধ্যে হারিয়ে যেতাম। অনেক সময়ই সবার ফেরা হত না।

প্রথমে কাউকে মরতে দেখলে ব্যাথা পেতাম। চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু জন্ম নিত। এখন সহ্য হয়ে গেছে। শহীদের জন্য প্রাণখুলে দোয়া করে দিই।

তারপর আবার বেরিয়ে আসি। বাগানের দেয়ালের কোনায় গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়াই। সামনে তাকাই।

সামনে উঁচুনিচু একটা জায়গা। একটা পুরনো দোতলা বিল্ডিং। আশেপাশের বিল্ডিংগুলোর একটাও দাঁড়ানো নেই। ভাঙ্গা বিল্ডিংগুলোর সামনে কিছুদূর এগোলেই সমতল একটা জায়গা। ওখানে ক্যাম্প করেছে ওরা।

ওরা কখনই আমাদের অংশ ছিল না। আমাদের দাদাদের কাছে শুনেছি। জাহাজে করে অল্প অল্প করে আসা শুরু করল ওরা। কেউ কেউ জমি কিনল। ওদের অসহায়ত্বের দিকে তাকিয়ে আমরা আশ্রয় দিলাম। তারপর।

তারপর জাতিসংঘে নাকি কি একটা আইন পাশ হল। মুহুর্তেই ওদের ভাবমুর্তি বদলে গেল। পশ্চিমা বড় বড় দেশের সাহায্যে আমাদের জায়গা দখল করে নিল। হত্যাযজ্ঞ চালাল।

এই গল্প আমার দাদার কাছে শোনা। এরকম গল্পের সাক্ষী আমার বাবাও। সেসময় আরবরাও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ওদের বড় বড় ট্যাংক, আর যুদ্ধবিমানের সাথে পেরে উঠল না।

গল্পটা কখনই শেষ হয় নি। যেন গল্পের লেখকের কোন বিশ্রাম নেই।

ওরা কখনই এই এলাকার অংশ ছিল না। তাই হয়ত মানুষসহ ভরা বিল্ডিং এর পর বিল্ডিং ধবংস করতেও ওদের বুক কাঁপে না।

ওদেরকে মারতে আমাদেরও হাত কাঁপে না। আরপিজি দিয়ে ট্যাংকটাতে হিট করতে পারলেই উল্লাসে ফেটে পড়ি। আল্লাহর প্রশংসায় অন্তর ভরে যায়।

গাছটার ছায়ায় বসে আবার সামনে তাকাই। কি যেন একটা শব্দ শুনি। ছুটে কমান্ডারের কাছে যাই। ওরা মনে হয় এদিকে মুভ করছে।

উনি আমার দিকে তাকালেন। চোখদুটো লাল। রাতভর নামাজ আর কুরআন তিলাওয়াতে কাটিয়েছেন। হাফেজ মানুষ।

আমাকে বললেন, আবার চেক করো। এদিকে তো আজই আসার কথা নয়।

আমি আবার আগের জায়গায় চলে এলাম। সামনে তাকাই। উঁচুনিচু একটা জায়গা। একটা পুরনো বিল্ডিং। মাঝে মাঝে তন্দ্রা আসে। ঝাপসা দেখি। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

চোখ খুললেই যেন চিৎকার চেঁচামেচি শুনি। সেদিন জাবালিয়ায় যা দেখেছি তা ভুলতে পারি না।

হাজারখানেক লোকের বসবাসের জায়গাটা, বিশাল এক পুকুর হয়ে গেছে।

বিল্ডিঙয়ের রড বালি বহুদূর ছড়িয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষের ছোটাছুটি।

কান্না।

এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাশ।

একজনও আস্ত নেই। কারো মাথাটা থেঁতলে গেছে।

এদিকে কিছু হাত পা ছড়িয়ে আছে। ওরা কলাম সরিয়ে শরীরটাকে খুঁজছে।

ডানদিকে রাস্তায় পুডিঙয়ের মত রক্ত।

কয়েকটা আঙ্গুল।

একটা আংটি।

রক্তের স্রোতধারা। কালও রক্ত, লাল রক্ত।

কয়েকটা বাচ্চার ছিন্নভিন্ন দেহ।

পাশে বসে এক মহিলা কাঁদছেন। হয়ত রেখে খাবার-পানি খুঁজতে গিয়েছিলেন। এসে আর বুকের মানিকদের জীবিত পাননি।

অসংখ্য মানুষের মৃতদেহের সারি দেখেছিলাম সেদিন।

তারপর রুদ্ধশ্বাসে পালিয়েছিলাম।

আমি একা না, অনেক মানুষ।

অসংখ্য মানুষ পিপড়ার মত ছুটছিল।

চোখেমুখে আতংক। মৌন সবাই।

হঠাত কে যেন বলে উঠল, ওদিকে যাবেন না। ওরা বোম ফেলছে। অনেকগুলো বিল্ডিং গুঁড়িয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ চাপা পড়ে আছে ওখানে।অনেককে ধরে নিয়ে গেছে। পাখির মত গুলি করে মারছে আমাদের, যাবেন না।

মনে হলো পায়ের সঙ্গে যেন কয়েক মণ পাথর বেঁধে দিয়েছে কেউ।

একা নই। অসংখ্য মানুষ। সহস্র চোখ। হতবিহ্বল মুহূর্ত। কোনদিকে যাব। পেছনে ফিরে যাওয়ার পথ নেই। মৃতদেহের স্তূপের নিচে সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

সামনে এগিয়ে যাব। ভরসা পাচ্ছিনে। সেখানেও হয়তো মৃতের পাহাড় পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

কোনদিকে যাব?

পরমুহূর্তে একটা জেটবিমানের শব্দ শুনতে পেলাম। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটতে লাগলাম আমরা। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। কাঁচকি মাছের মতো চারপাশে ছিটকে যাচ্ছে সবাই।

মাথার ওপরে নেমে এলো।

তারপর।

তারপর মনে হলো একসঙ্গে যেন অনেকগুলো বাজ পড়ল। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। সব কিছু ঝাপসা হয়ে এলো। মনে হলো চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছে। বুঝতে পারলাম জ্ঞান হারাচ্ছি। কিংবা মারা যাচ্ছি।

সামনে উঁচুনিচু একটা জায়গা। পিছনে একটু দূরে কয়েকটা ঝোপগাছ। আড়ালে একটা শেয়ালের গর্তের মত গর্ত। ওটা আমাদের টানেলের মুখ। মাটির সত্তর ফুট নিচে আমাদের বাস। দুই মাস ধরে আছি এখানে। এখানেই খাই, এখানেই ঘুমাই।

লম্বা টানেলের এদিকে ওদিক মিলিয়ে ষাটজন মানুষ আমরা। প্রথমে আটত্রিশ জন ছিলাম। শত্রুরা এইদিকে আসায় আরও পঞ্চাশজন এল। বিভিন্ন অভিযানে গিয়ে আর এলো না বিশজন। আটজন অন্য এলাকায় গেছে।

এতগুলো মানুষ আমরা। বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন পেশার।

আমার বন্ধুও আমরও ছিল সাথে। যেদিন ওরা আমাদের ভার্সিটিটা উড়িয়ে দেয়, ভীষণ মন খারাপ করেছিল সে। আমাদের কত স্মৃতিময় বিশ্ববিদ্যালয়।

এইতো সেদিন। বছরখানেক হবে। থার্ড ইয়ারের প্রোজেক্টের কাজ করতে করতে ও বলছিল, দেখ, আমরা কেমন একা হয়ে গেছি না রে। আমি কৌতূহলী হয়ে তাকাতেই ও বলল, আজ দেড় যুগ ধরে আমরা অবরুদ্ধ। অথচ কোথায় আরবরা, কোথায় মুসলিম ভাইয়েরা। আমাদের একা ছেড়ে আজ কত সম্পদশালী মুসলিম দেশের শাসকরা উদাসীন।

এর কিছুদিন পরে আমরা তিনজন কাস ~ সাম ব্রিগ এডে যোগ দিই। আমাদের সাথে উসমানও ছিল। ওর খুব ইচ্ছা ছিল আকসাকে স্বাধীন করে সেখানে নামাজ পড়বার।

ওর অভিযান পড়ে ভিতরে। সাত তারিখ সকালে বের হওয়ার আগে বলে যায়, আকসার দিকে যাচ্ছি।

ও গিয়েছে আর ফিরে আসে নি। আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন।

আমি ফিরে আসলাম। তথ্য সংগ্রহের জন্য গিয়ে যা দেখেছি তা আগে কখনও দেখি নি। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মুখ একটা ট্রাকের পিছনে ছুটছে। তারপর দূর থেকে কয়েকটা বিস্ফোরণ। সেই ট্রাকটা ফিরে এসেছে। তবে অনেকগুলো লাশ নিয়ে। ওরা কিছুই বাদ দেয় নি।

হাসপাতাল।

স্কুল।

বাড়ি।

মসজিদ।

চার্চ।

বুড়ো মানুষ, শিশু মানুষ।

সদ্য জন্ম নেয়া, এমনকি মায়ের পেটেও।

কাউকেই বাদ দেয় নি ওরা।

হাজার হাজার মানুষ ছুটছে। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, খাবারের খোঁজে।

খাবারের অভাবে মারা যাওয়া হাড় লিকলিকে শিশুটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদেছিলাম সেদিন। কয়েকদিন খাবার মুখে তুলতে পারি নি।

মাঝে মাঝে ঝিম মেরে বসে থাকি, আর ভাবি। ওরা কিভাবে খায়।

স্মার্টফোনের পর্দায়, টিভির পর্দায় লাইভ টেলিকাস্ট দেখে। হত্যার খবর শোনে। ধর্ষণের ঘটনা কানে যায়। নির্বিকারে জীবনধারণ করে।

ওরা কি মুসলিম না!

ওরা কি মানুষ না!

একশ একচল্লিশ বর্গ মাইলের এই বাইশ লক্ষ মানুষ কি ওদের ভাই না! বোন না!

মাঝে মাঝে আমরা কুঠুরিতে বসি। দেয়ালে অনেকগুলো দাগ। আমাদের সংখ্যা না, ওদের! মাঝে মাঝে গুনি। ট্যাংকের মধ্যে গ্রিল হতে থাকা চেহারাটা কল্পনা করি। ওপারে ওদের জন্য অপেক্ষা করা জাহান্নামের কথা ভাবি।

আমাদের যারা মারা যায় তাদের সংখ্যাও গুনি। যেন বসে বসে জান্নাতের সবুজ পাখি গুনছি।

মাঝে মাঝে ঈর্ষা হয়।

সেদিন কাছেই একটা গোলা এসে পড়ে। পায়ে আঘাত পাই।

কয়েকদিনের বিশ্রাম। নামাজ দাঁড়িয়ে পড়তে পারি না। বসে পড়তে হয়।

মা কাছে থাকলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। বলতেন, কি দরকার ছিল অত বাহাদুরি করে সামনে যাওয়ার।

চোখের কোনে এক ফোঁটা অশ্রু জমা হল। পড়লাম, রাব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানি ছগিরা।

আমি একা নই হাজার হাজার মানুষ পরিবার হারিয়েছে। অনেকের পুরো বংশে কেউ বেঁচে নেই।

মাঝে মাঝে তরবিয়তি মজলিস হয়। সেদিন ক্যাম্প কমান্ডার একটা খোলা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, কেন লড়ছি আমরা?

একেকজন একেকভাবে উত্তর দিল। কেউ বলল, প্রতিশোধের জন্য লড়ছি আমরা।

আরেকজন বলল, মাতৃভূমির জন্য।

আমারও কৌতূহল হল, কেন লড়ছি আমরা?

বেঁটে করে ছেলেটার উত্তরটা মনে ধরল। উৎসুক সূরে ও বলে উঠল, জান্নাতকে সামনে রেখে জীবনের জন্য লড়ছি আমরা। অস্তিত্বের প্রয়োজনে। যেন চোখগুলো ঠিকরে বের হয়ে আসবে।

এরকম চোখ আমি অনেক দেখেছি। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। ওদের বুলডোজার চাপায় হারিয়ে যায় নি, বরং বেড়ে গেছে। দুই গুণ, চার গুণ, শত সহস্র গুণ।

যেন এক জোয়ার চলছে এখানে। যেন সারা পৃথিবী মৃত, তার মাঝে জীবন্ত এক ভূমি।

রাজনীতির হিসাব নিকাশ আমি অত বুঝি না। শুধু বুঝি এ যুদ্ধে আমরা জিতবই।

আজ, কাল কিংবা পরশু।

লক্ষ লক্ষ টন বোমা, সুপারসনিক বিমান আমাদের হারাতে পারবে না। আমরা সফল। উভয় জগতেই।

একদিন আমি আবার ফিরে যাব। নতুনদের গল্প শোনাব। যারা নেই, তাদের গল্প।

সেই ছেলেটার গল্প, যে খালি পায়ে ট্যাংকের গায়ে বোমা লাগিয়ে এসেছে।

অসংখ্য গল্পে রাত গভীর হবে। আমার গল্প তবুও ফুরোবে না।

সামনে উঁচুনিচু একটা জায়গা। একটা দোতলা পুরনো বিল্ডিং। দূরে ঘাটি করেছে ওরা।

ডায়েরীতে আর কিছু লেখা নেই। আমি বললাম, কার লেখা, আপনার?

কমান্ডার বললেন, আমাদের সাথের একজন মুজাহি,দের।

জিজ্ঞেস করলাম, একটা সাক্ষাৎকার নেয়া যাবে।

উনি বললেন, কয়েকদিন আগে এক অপারেশনে গিয়ে শ!হীদ হয়েছে।

পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে আমি বের হয়ে আসলাম। সামনে যেন দেখলাম।

উঁচুনিচু একটা জায়গা। একটা দোতলা পুরনো বাড়ি।

দূরে কিছু একটা জ্বলছে। যেন একটা ট্যাংক।

পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। কিছু লিখি। তারপর আবার মুছে ফেলি। লেখা আর মুছে ফেলার মাঝে কিছু থেকে যায়। সেগুলোর জন্যই এখানে আসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top