স্কুল কলেজের শিক্ষায় দ্বীনি উদাসীনতা এবং আমাদের করনীয়-৭ [শেষ পর্ব]

স্কুল কলেজের শিক্ষায় দ্বীনি উদাসীনতা এবং আমাদের করনীয়-৭ [শেষ পর্ব]

বিগত আলোচনাগুলোতে যুবকদের কার্যক্রম এবং ফান্ডের গঠন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, পঞ্চম পর্বে যে যুবকদের প্লাটফর্ম এর কথা বলেছিলাম, ফান্ড যে তাদেরকেই করতে হবে ব্যাপারটা এমন হওয়া বাধ্যতামূলক না।

এই কাজগুলো প্যারালাল হতে পারে। এলাকাভিত্তিক/প্রতিষ্ঠানভিত্তিক যুবক/শিক্ষার্থী মিলে একটা প্লাটফর্ম গড়ে তুলল। যে কার্যক্রমগুলো বলেছি বেশীরভাগই খুব স্বল্প অর্থায়নে হয়ে যেতে পারে। তারা তাদের সামর্থ অনুযায়ী কার্যক্রম 

হাতে নিবে। 

অন্যদিকে এলাকা/প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ফান্ডগুলো গড়ে উঠবে। এই ফান্ডগুলোর আর্থিক ব্যয় নিয়ে আগের পর্বে কথা বলেছি। তারই একটা ব্যয়ের খাত হতে পারে এই প্লাটফর্মগুলো।

প্লাটফর্মের এক বা দুইজন এসব ফান্ডের সদস্যদেরকে প্রস্তাব দিবে তাদের কার্যক্রমে অংশ নিতে। এমনো হতে পারে কোন এক প্লাটফর্মের একজন এসব ফান্ডেরও সদস্য। ফান্ডের সেই সদস্য তাদের পরবর্তী পলিসি মিটিঙয়ে বিষয়গুলো উত্থাপন করবে এবং কি পরিমাণ অর্থায়ন করা যায় তা নির্ধারণ করবে।

প্রতিটি প্রজেক্ট শেষে প্লাটফর্মগুলো তাদের অর্থ আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সরবরাহ করবে স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য। তারা শুধুমাত্র এরকম ফান্ডের কাছেই যাবে না, বরং দ্বীনি কাজে আগ্রহ আছে এরকম পরিচিত লোক খুঁজে বের করবে এবং তাদেরকে অর্থায়নের জন্য বলবে। অবশ্য কাজের অগ্রগতি দেখেই অনেক মানুষ আগ্রহী হবে ইনশাআল্লাহ।

এবার আসুন, একটু জুম আউট করি। একটু উপর থেকে দেখার চেষ্টা করি। 

ধরা যাক, বিভিন্ন এলাকায়/ প্রতিষ্ঠানে এসব কার্যক্রম শুরু হল। প্রথমে তারা নিজেরা অর্গানাইজ হল। দুই চারজন কিংবা দশ জন। একটা এলাকায় কার্যক্রম শুরু করতে এরাই যথেষ্ট। তারা কি কি সমস্যার মুখোমুখি হবে? 

অর্থের সংকুলান কোন না কোন ভাবে হয়েই যাবে। এ বিষয়ই কিছু ধারণা তো উল্লেখ করাই হল। সমস্যা তৈরি হবে রিসোর্স নিয়ে।

১। প্রথমত, তারা যে সেমিনার গুলো করবে সেগুলোর জন্য যে প্রেজেন্টেশন/অন্যান্য ম্যাটারিয়াল লাগবে সেগুলো কে তৈরি করে দিবে? একটা মানসম্পন্ন সেমিনারে কথা বলার জন্য যে বক্তা লাগবে সেই বক্তা কে হবে? যদি তাদের মধ্য থেকে হয় তাদের কে ট্রেনিং দিবে? প্রত্যেক এলাকায় তো আর আমরা এ ধরণের এক্সপার্ট থাকবে এ আশা করতে পারি না।

২। তারা যদি এলাকায় বিভিন্ন লিফলেট, পুস্তিকা বিতরণ করতে চায় সেগুলো কোথা থেকে পাবে? প্রিন্ট কোথা থেকে হবে?

৩। তারা যে ইসলামের ইতিহাস, সীরাত ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতা আয়োজন করবে সেগুলোর জন্য ছোট বই, প্রশ্ন এসব কোথায় পাবে? 

৪। ক্যারিয়ার, জীবন ঘনিষ্ঠ পরামর্শ বিষয়ক যে আয়োজন গুলো তারা করবে সেসব বিষয়ে তো আগে তাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সেটা কে দিবে?

৫। তারা মসজিদভিত্তিক যে আয়োজন করবে সেগুলোতে নির্দিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কথা বলার জন্য আলেম কারা হবে?

৬। তারা যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার কথা বলবে, সচেতন করবে অভিভাবকদের এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য আদর্শ সিলেবাস ও বই কোথায় পাবে?

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, প্লাটফর্মগুলো গঠন করার পাশাপাশি এসব বিষয় সমাধান করতে হবে। যেহেতু আমরা চাচ্ছি বাংলাদেশের আনাচে কানাচে সব জায়গায় সব প্রতিষ্ঠানে এসব প্লাটফর্ম গড়ে উঠুক, সেহেতু এগুলোর সুরাহা করা দরকার। আর যেহেতু এগুলোর কার্যক্রম একই, সেহেতু একটার জন্য সমাধান আসলে সবগুলোর জন্যই সমাধান।

কাজেই একটা সামাজিক শিক্ষামূলক আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে আমাদেরকে জাতীয় পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে।

আমাদেরকে কিছু উন্মুক্ত রিসোর্স প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে যারা নিচের কাজগুলো করবে। 

১। তারা বর্তমানের বিভিন্ন সমস্যা, বিভিন্ন আইডিয়া বিষয়ক সেমিনারের জন্য রিসোর্স ম্যাটারিয়াল তৈরি করবে।

২। তারা ক্যারিয়ার বিষয়ক বিভিন্ন গাইডেন্স দাঁড় করাবে, যেগুলো অনুসরণ করলে একজন শিক্ষার্থী হতাশা ছাড়াই তার শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারে, তার পছন্দের পেশা গ্রহণ করতে পারে এবং এ ধরণের ভবিষ্যৎ প্রজেক্টে সাপোর্ট দিতে পারবে।

৩। তারা বিভিন্ন লিফলেট, পুস্তিকা তৈরি করবে বিতরণের উপযোগী করে। অডিও ও ভিডিও রিসোর্স তৈরি করবে।

৪। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার জন্য পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ছোট ছোট পুস্তকাদি, প্রশ্ন ইত্যাদি তৈরি করবে।

৫। এসব রিসোর্সের জন্য একটা ন্যাশনাল আর্কাইভ তৈরি করবে। যাতে সহজেই ফিল্ড লেভেলের প্লাটফর্মগুলো এসব ম্যাটারিয়াল এক্সেস করতে পারে।

৬। তারা নিয়মিত ট্রেনিং এর মাধ্যমে জাতীয়, বিভাগীয়, জেলাভিত্তিক কিছু বক্তা/প্রেজেন্টার তৈরি করবে যারা ফিল্ড লেভেলের প্লাটফর্মগুলোর জন্য একই সাথে ট্রেইনার, অতিথি হিসেবে কাজ করতে পারবে।

৭। স্থানীয় বিভিন্ন হক্কানী আলেমদের খুঁজে বের করবে। জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা উপজেলাভিত্তিক আলেমদের সাথে সমন্বয় করে এ ধরণের প্রজেক্টের যে কোন বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য রাজি করাবে। বিশেষ করে যেসব আলেমরা শিক্ষার্থী ও যুবকদের জন্য আলোচনার জন্য আগ্রহী, একইসাথে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তির, দাওয়াতি কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। 

৮। আলেমদের সাথে সমন্বয় করে ইসলামিক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আদর্শ সিলেবাস ও বই প্রণয়নের কাজ করবে।

ইত্যাদি ইত্যাদি।

উপরের কাজগুলোর জন্য এমন না যে একটা টিমকেই কাজ করতে হবে। বরং অনেকগুলো টিম একই উদ্দেশ্যে কাজ করতে পারে। 

আর এসব নেটওয়ার্ককে সমন্বয়ের জন্য একটা কমন ওয়েবসাইট/ সিস্টেম ডেভেলপ করতে হবে। যাতে একদিকে এসব রিসোর্স এর জন্য আর্কাইভ গড়ে তোলা যায়, অন্যদিকে রিসোর্স পারসন, ট্রেইনার, ফান্ড, ফিল্ড প্লাটফর্ম ও আলেমদের সাথে যোগাযোগ সহজতর হয়। একইসাথে রিপোর্ট তৈরি, নীতিমালা তৈরি ইত্যাদি অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ের একত্রীকরণ ও স্টান্ডারডাইজেশন সহজ হয়।

এ পর্যন্ত যা বললাম, এই কাজগুলো এক দিনে গড়ে উঠবে না। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলোকে প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে তাই শেয়ার করা। 

এই কাজগুলো আমরা কেন করব? 

একজন সচেতন মুসলিম যুবক হিসেবে আমাদের যেমন নিজেদের তরবিয়ত প্রয়োজন, তেমনি আমাদের দ্বীনহীন শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের যে ভাইবোনেরা যাচ্ছে তাদের তৈরি করা প্রয়োজন। 

কারণ, এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গিয়েই আমরা সমাজের বিভিন্ন স্থানে পারফর্ম করছি এবং তথাকথিত সেক্যুলার ব্যবস্থার পিলার হিসেবে কাজ করছি। আমরা যদি কিছু না করি তাহলে ভবিষ্যৎ এ এর কোন উন্নতি তো আশাই করতে পারি না। 

আলেমরা অনেক চেষ্টা করছেন, দ্বীনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের দরকার হল তাদের ও সাধারণের মাঝে একটা ব্রীজ হিসেবে কাজ করা। 

আমাদের কার্যক্রম খুবই সামান্য, হয়ত এ দিয়ে তেমন কিছু হবে না। কিন্তু বর্তমানে সমাজে যে এক ধরণের দ্বীনি শিথিলতা, উদাসীনতা, নীরবতা রয়েছে, ইসলাম ভিত্তিক শিক্ষাকে ছোট করে দেখার যে প্রবণতা রয়েছে সেই ক্ষেত্রে ইনশাআল্লাহ কিছুটা হলেও কাজ করবে। 

আলেমরা অনেক চেষ্টা করছেন, দ্বীনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের দরকার হল তাদের ও সাধারণের মাঝে একটা ব্রীজ হিসেবে কাজ করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, এক আঘাতে পাথর ভাঙ্গে না। আঘাত করতে করতে এক সময় ভাঙ্গার সময় হয়ে আসে। আমরা না হয় প্রথম দিকের আঘাতের কাজটাই করলাম।

কাজেই আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য, একটি নৈতিক মূল্যবোধ যুক্ত সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, একটি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তির জন্য আমাদেরকে নিজেদের আরামের অবস্থান ত্যাগ করে, আশু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আল্লাহ তাআলা আমাদের যে হায়াত দিয়েছেন তার সদ্ব্যবহার করা প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলাই একমাত্র তৌফিকদাতা।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে নিয়ামত দিয়েছেন, তার সদ্ব্যবহার করার তৌফিক দিন এবং আমাদেরকে হেদায়েত দিন, মৃত্যু পর্যন্ত হেদায়েতের উপর রাখুন। আমিন।

পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। কিছু লিখি। তারপর আবার মুছে ফেলি। লেখা আর মুছে ফেলার মাঝে কিছু থেকে যায়। সেগুলোর জন্যই এখানে আসা।

One thought on “স্কুল কলেজের শিক্ষায় দ্বীনি উদাসীনতা এবং আমাদের করনীয়-৭ [শেষ পর্ব]

  1. অনেক ভাল লাগলো,,,,এই সাইটে এসে সময় করে পড়ে নেওয়া যাবে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top