আশার কথা হচ্ছে বর্তমানে অনেকেই স্কুল, সিলেবাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবছেন। আমরাও তাদেরই এক অংশ। কিন্তু এসব করতে গিয়ে মানহীন প্রতিষ্ঠান ও বইয়ে সয়লাব হয়ে গিয়ে যেন উলটো ক্ষতি না করে সেটাও খেয়াল রাখার বিষয়।
কাজেই এসব বিষয়ে যারা কার্যক্রম হাতে নিবেন তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান ভিজিট করে, দেশ বিদেশের বিভিন্ন সিলেবাস পর্যালোচনা করে, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে সিলেবাস ও সেই অনুযায়ী বই প্রণয়ন
করা।
ব্যাপারটা এমন না যে আমরা দুম করে নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলছি। দেশে বিদেশে অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের পড়াশোনার মান বিশ্বমানের। আমার মনে হয় এই সিলেবাস বা প্রতিষ্ঠানের মডেলগুলো হুবহু কপিপেস্ট করা যে উচিত না এইটা অনেকের মাথায় ধরে না।
আমাদের দরকার গ্রাম ও শহরগুলোর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, প্রাইভেট বিদ্যালয় কাঠামো ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য করে এমন কারিকুলাম প্রণয়ন করা যেটা সহজে বাস্তবায়নযোগ্য। সহজে বাস্তবায়ন শব্দ দেখে অনেকে ভাবতে পারে যে মান কমিয়ে দেয়া। না, বরং এর মানে হচ্ছে আমাদের সামর্থ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে সিলেবাস ও বই প্রণয়ন করতে হবে।
তো এখন মূল কথায় আসি। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিয়ে আমার একমাত্র অভিজ্ঞতা হল আমি প্রচলিত শিক্ষা কাঠামো পেরিয়ে আসা একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। এর বাইরে আমার কোন অভিজ্ঞতা নাই, আমি কোনদিন কোথাও শিক্ষা প্রদানও করি নি। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, এগুলো নিয়ে কথা বলছি কেন?
কথা বলছি কারণ, এসব নিয়ে আমাদের কোন সমন্বিত উদ্যোগ নাই। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি করছেন, সফলতার সাথে চালিয়েও নিচ্ছেন। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ভাবে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কি পরিমাণ খাটাখাটুনির মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেটা যারা যান তারাই ভালো জানেন।
কাজেই আমাদের ইসলাম ভিত্তিক সার্বজনীন শিক্ষা কারিকুলাম থাকতে হবে। কয়েকটা ভার্সন থাকতে পারে। অবস্থা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ তাদের উপযোগী সিলেবাস বাছাই করে নিবে। এই সিলেবাসের জন্য সামর্থের মধ্যে বই প্রণয়ন করতে হবে। ইতোমধ্যেই অনেক ভালো বই আছে। সেগুলো থেকেও বাছাই করা যেতে পারে।
আর এই রিসোর্সগুলো হতে হবে সহজে এক্সেসিবল। সাধারনেরাও যেন এগুলো নাগালে পায় সেটাই মূল ফোকাস হতে হবে। শিক্ষকদের জন্য রিসোর্স ম্যাটারিয়াল বানাতে হবে। প্রতিটি শ্রেণীর প্রতিটি বিষয়ের শিখন শেখানোর কার্যাবলী, পাঠের আউটকাম নির্দিষ্ট করতে হবে শিক্ষার্থীর মানসিকতা অনুযায়ী।
মোদ্দাকথা হল, সহজপ্রাপ্য রিসোর্স ডেভেলপ করতে হবে। আর এটা দুই চারদিনে তৈরি হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোটি কোটি টাকা ঢেলে, রাষ্ট্রের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের নিয়োজিত করেও একটা সিলেবাস ও তার পুস্তক প্রণয়ন করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। সেখানে সাধারণ কিছু মানুষের উদ্যোগে হাতে কানাকড়ি ছাড়া, লোকবল একখানে করে, সিলেবাস নিয়ে গবেষণা করা, পুস্তক প্রণয়ন চাট্টিখানি কথা নয়। আবার সেটা যেহেতু দুনিয়াবি ও দ্বীনি শিক্ষার সংমিশ্রণ, কাজেই আলেম ওলামাদের একটা বড় অবদান রয়েছে সেখানে। কাজেই এটা করতে যে কয়েক বছর লেগে যাবে সেটা বলাই বাহুল্য।
কাজেই কিছু পয়েন্ট নোট করা যাক।
১। এই সিলেবাস হবে সাধারণ (অরাষ্ট্রীয়) উদ্যোগে তৈরি যেখানে দুনিয়াবি শিক্ষা কম্প্রোমাইজ না করে দ্বীনি শিক্ষা দেয়া হবে।
২। প্রচলিত শিক্ষা কাঠামো ও সিলেবাসের বিষয় ও কাঠামোকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
৩। সিলেবাসের কয়েকটি ভার্সন থাকবে যাতে গ্রাম, শহর, কম খরচ, বেশী খরচ সব ধরণের প্রতিষ্ঠান তাদের উপযোগী একটি কাঠামো অনুসরণ করতে পারে।
৪। কারিকুলাম তৈরির পূর্বে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় শিক্ষা কারিকুলাম, দেশ বিদেশের ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম, শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ইত্যাদি ভালোভাবে গবেষণা করতে হবে।
৫। কারিকুলাম অনুযায়ী আউটকাম ভিত্তিক পুস্তক প্রণয়ন করা হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক বিষয় সেই বিষয়ের এক্সপার্টদের দ্বারা প্রণীত হবে এবং ভালো ভালো শিক্ষকদের দ্বারা অনেকদিন পর্যালোচিত হবে, তাদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত ভার্সন প্রকাশিত হবে।
৬। পুস্তকের মূল্য থাকবে জনসাধারণের হাতের নাগালে, কিন্তু তার পাঠ হবে উন্নতমানের। শিক্ষকদের জন্য রেফারেন্স পুস্তক প্রণীত হবে।
৭। প্রত্যেকটা বই আলেম উলামাদের দ্বারা পর্যালোচিত হবে।
৮। শিক্ষকদের ট্রেইনিং এর জন্য অনলাইন ও অফলাইন বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
৯। অভিভাবকদের জন্য প্রয়োজনীয় গাইডেন্স সম্বলিত পুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।
১০। এই সমস্ত রিসোর্সের অনলাইন ও অফলাইন কপি সহজপ্রাপ্য হবে।
১১। অনলাইনে এগুলোর জন্য ফ্রি রিসোর্স যেমন- পিডিএফ কপি, ফ্রি ক্লাস উন্মুক্ত থাকবে।
১২। একটা অডিট টিম থাকবে, যারা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুরোধে সেগুলো ভিজিট করে সেগুলোর উন্নয়নের জায়গাগুলো চিহ্নিত করবে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর মান ধরে রাখা সহজ হবে এবং অভিভাবকরাও চিন্তামুক্ত থাকবে।
১২। এই কাজ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য করা হবে।
এসব প্রাথমিক ধারণা মাত্র। এ কাজের প্রথম ও প্রধান কাজ হল উপযুক্ত টিম গঠন করা, দীর্ঘ সময় প্রজেক্ট মেইন্টেইন করা, আর্থিক দিকগুলো সামাল দেয়া।
সারকথা হল, যখন একটি মানসম্পন্ন কারিকুলাম ও তার রিসোর্স সহজপ্রাপ্য হবে তখন এই রিসোর্স ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাও সহজ হবে। আর এজন্য দরকার অদম্য ইচ্ছা সম্পন্ন কিছু মানুষ যারা বিভিন্ন সমালোচনা, বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে কেবল আল্লাহর সন্তষ্টির জন্য কাজ করবে।
এ তো গেল ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা। তাহলে যারা অলরেডি কলেজ পাশ করে বের হয়েছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, চাকরি করছেন, কিংবা সামাজিক শিক্ষামূলক উদ্যোগে শরিক থাকতে চান তারা কি করবেন?
তাদের জন্য রয়েছে অনেক কাজ। আসছে পরের পর্বে ইনশাআল্লাহ।