আগের পর্বে আমরা দেখেছি যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জেনারেটর থেকে শুরু করে আমাদের বাড়ির লাইট পর্যন্ত সারা দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা একটা বৃহৎ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। এই পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বা পাওয়ার সিস্টেমকে গ্রিড বলা হয়। এটিকে বৃহৎ একটি মেশিনও বলা যায়।
তার মানে হল এই সিস্টেমে কোন কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। এর এক অংশে কোন পরিবর্তন করলে তা যত ক্ষুদ্রাকারেই হোক না কেন অন্য অংশে প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ আমি যদি আমার ঘরের লাইট বন্ধ করি বা এসি চালাই এর একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। কারণ আমি যখন একটা এক্সট্রা লাইট জ্বালাব, সেটা যে বিদ্যুৎ গ্রহণ করবে সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ তো উৎপাদন করতে হবে।
এখন এত ক্ষুদ্র পরিবর্তনের সাথে সাথে তো আর উৎপাদনকে পরিবর্তন করা সম্ভব না। তাহলে সামান্য বর্ধিত চাহিদা কিভাবে মিটবে?
আগের সেচের গল্পে করা ড্রেনের পানির উচ্চতার কথা মনে আছে? ড্রেনের পানির উচ্চতা সাড়ে ৪ ফুট মেইনটেইন করার কথা। এখন ছোট একটা ড্রেন খুলে দিলে পানির চাহিদা কিছুটা বেড়ে যাবে। এর ইফেক্ট কি হবে? ড্রেনে পানির উচ্চতার পরিবর্তন ঘটবে। পাম্প দ্বারা সরবরাহকৃত পানি যদি একই রকম থাকে তবে চাহিদা সামান্য বাড়লে পানির উচ্চতা সামান্য হ্রাস পাবে। আর চাহিদা সামান্য বাড়লে ড্রেনের পানির উচ্চতা সামান্য বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ পানির উচ্চতার হ্রাস বৃদ্ধি ঘটার মাধ্যমে পানির চাহিদার ছোট খাট পরিবর্তনকে মিটানো সম্ভব হবে।
একই রকম ঘটনা বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও ঘটে। আমরা বিদ্যুতের ফ্রিকোয়েন্সি সম্পর্কে জেনে এসেছি। আমাদের দেশে তা ৫০ হার্জ। আর আমাদের গ্রিডে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা শীতকালে ৯ হাজার মেগাওয়াট, গ্রীষ্মে তা ১৪ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ বিদ্যুৎ ব্যাবস্থার টার্গেট হল যখন যে চাহিদা থাকবে তা এই ৫০ হার্জ ফ্রিকোয়েন্সি বজায় রেখে সরবরাহ করা। আর এই কাজটা করে থাকে পিজিসিবির আওতাধীন এনএলডিসি। তারা গ্রিডে যুক্ত বিভিন্ন স্টেশন সাবস্টেশনের সাথে যোগাযোগ করে এই ফ্রিকোয়েন্সি বজায় রাখার চেষ্টা করে।
তাহলে যখন উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা অল্প পরিমাণে (কয়েক মেগাওয়াট) বাড়বে, তখন ফ্রিকোয়েন্সি কমে যাবে। আবার কমে গেলে ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাবে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে আমরা তো ফ্রিকোয়েন্সি কমতে বা বাড়তে দিয়ে চাহিদা বা লোডের বড় পরিবর্তনকে সহজেই মোকাবিলা করতে পারি। সমস্যা কোথায়?
সমস্যা হল উৎপাদন ব্যবস্থায়। আমরা আগে জেনে এসেছি ফ্রিকোয়েন্সি বাড়লে স্পিড বাড়বে। ফ্রিকোয়েন্সি কমলে স্পিড কমবে। তার মানে যখন ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যাবে তখন জেনারেটরের রোটরের স্পিড বেড়ে যাবে তথা এর সাথে যুক্ত টারবাইনের স্পিড বেড়ে যাবে। আর এই টারবাইন ব্যবস্থা একটা বৃহৎ জিনিস, একে চালাতে জ্বালানি কন্ট্রোল করতে হয় সুক্ষ্মভাবে, তেমনি এত ভারি জিনিসকে চাইলেই যে কোন স্পিডে চালানো যায় না। মোদ্দাকথা হল, একে একটা নির্দিষ্ট স্পিডের জন্য ডিজাইন করা হয়। এর থেকে খুব বেশী বা কম হলে এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরো গ্রিড থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে এবং বন্ধ হয়ে যাবে।
আসলে গ্রিডের প্রত্যেকটি উপাদানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। সেটা জেনারেটর হোক, ট্রান্সফরমার হোক কিংবা পরিবহন তার। এদের প্রত্যেকের প্রধান লক্ষ্য হল নিজের ক্ষতি না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা পরিবহন করা। পরিবহন তার গুলোর কোন কাভার থাকে না, তাই অনেক সময় গাছ বা পাখির কারণে দুই তিনটি তার একসাথে শর্ট হয়ে যেতে পারে। তখন ওই তার দিয়ে পরিবাহিত বিদ্যুৎ অনেক বেড়ে যায়, এর ফলে তারের দুই মাথার সার্কিট ব্রেকার নির্দিষ্ট সময় পর (সেকেন্ডের ভগ্নাংশ) সিস্টেম থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে। একে আমরা বলি ট্রিপ করা।
একইভাবে ট্রান্সফরমারও বিভিন্ন কারণে যেমন – এর অভ্যন্তরীণ সমস্যা, ওভারলোড ইত্যাদি কারণে ট্রিপ করে। আর উৎপাদন ব্যবস্থায় জ্বালানি, বাষ্প, মেশিন এদের কন্ট্রোল এবং অবস্থার বিবেচনায় কোন ত্রুটি হলে ট্রিপ করতে পারে, এমনকি জেনারেটরের নিজস্ব ত্রুটি এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণেও। অনেক সময় অপারেটরের ভুলবশত এসব জিনিস গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো সাধারণত তাদের কোন মুহুর্তের প্রাপ্ত বিদ্যুতের সাথে সমন্বয় করে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। আর একাজ করার জন্য কিছু গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখে। আর একে আমরা বলি লোডশেডিং। অর্থাৎ আপনার এলাকায় লোড শেডিং হওয়ার অর্থ চাহিদার তুলনায় কম বিদ্যুৎ আপনার এলাকায় আসছে এবং গ্রিডে এর ইফেক্ট কমানোর জন্য লোডশেডিং করা হচ্ছে।
এখন যদি কোন কারণে (শর্ট সার্কিট বা অন্য কারণে) লোডের বড় পরিবর্তন ঘটে (চার পাঁচশ মেগাওয়াট), তবে এর কারণে ফ্রিকোয়েন্সির পরিবর্তন ঘটবে। এমনকি তা ৪৮ হার্জের নিচে কিংবা ৫২ হার্জের উপরেও চলে যেতে পারে। আমাদের জেনারেটরগুলো সাধারণত এই সীমার ভিতরে চলে। এই সীমার বাইরে গেলে জেনারেটর গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
ঠিকমত সামাল দিতে না পারলে এখান থেকে একটা ভয়াবহ ঘটনার সুত্রপাত হতে পারে। ধরা যাক লোড বেড়ে ফ্রিকোয়েন্সি কমে গিয়ে একটা মাঝারি বিদ্যুতকেন্দ্র (২২৫ মেগাওয়াট) বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। এর মানে হল উৎপাদন আরো কমে গেল। তাহলে ফ্রিকোয়েন্সি আরো কমে যাবে। এভাবে একে একে সব জেনারেটর বন্ধ হয়ে গিয়ে গ্রিড পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বিদ্যুৎ বিহীন হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থাকে বলা হয় ব্ল্যাকআউট বা গ্রিড বিপর্যয়।
একবার গ্রিড বিপর্যয় হলে সেখান থেকে রিকোভার করা একটু কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। কারণ ইঞ্জিনচালিত ছাড়া বেশীরভাগ বিদ্যুতকেন্দ্র চালু করতে বিদ্যুতের দরকার হয়। আর গ্রিডে কোন বিদ্যুৎ না থাকায় এগুলো চালু করা কঠিন। ইঞ্জিনচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটিও কম হয়। এগুলো দিয়ে আস্তে আস্তে গ্রিড চার্জ করে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় লোড এবং ভোল্টেজে আনা হয়। বড় বিদ্যুতকেন্দ্র চালু করে ফুল লোডে আনতেও দুই তিন ঘন্টা সময় লাগে। তাই সব মিলিয়ে একটি গ্রিড বিপর্যয় মানে যেমন জনগণের দুর্ভোগ, সাথে সাথে সারা দেশের হাজার হাজার বিদ্যুৎ কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম।