বিদ্যুৎ সমাচার – ৪ঃ জাতীয় গ্রিড (২য় অংশ)

বিদ্যুৎ সমাচার – ৪ঃ জাতীয় গ্রিড (২য় অংশ)

গত পর্বে ছোট একটা উদাহরণ দিতে গিয়ে অনেক বেশী বলে ফেলেছিলাম। আসলে গ্রিড ব্যাপারটা খুব কঠিন কিছু না। আমি আসলে এক উদাহরণে অনেক কিছু কাভার করতে চেয়েছিলাম তাই বড় হয়ে গেছে। যাই হোক মূল ব্যাপারটায় যাওয়ার আগে আরো দুই একটা প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করে নেই।

বিদ্যুতের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল ভোল্টেজ আর কারেন্ট। আমরা তো বিদ্যুতকে কারেন্ট বলে বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আসলে কারেন্ট মানে হল প্রবাহ বা স্রোত। বিদ্যুৎ ব্যাপারটা ইলেকট্রনের স্রোত ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমরা জানি, পানির স্রোত উঁচু জায়গা থেকে নিচু জায়গার দিকে প্রবাহিত হয়। উঁচু আর নিচু জায়গার মধ্যে উচ্চতার পার্থক্য যত বেশী হয় পানির প্রবাহ পাওয়া তত সহজ হয়। অনেকটা পানির ট্যাঙ্ক থেকে পাইপ দিয়ে ট্যাপে পানি নেয়ার মত।

ট্যাপে পানি পাওয়ার জন্য আমরা পানির ট্যাঙ্ককে উঁচু জায়গায় স্থাপন করি। তেমনি ইলেকট্রনের স্রোত বা বিদ্যুৎ প্রবাহ পাওয়ার জন্য আমাদের উঁচু ভোল্টেজ নিচু ভোল্টেজ তৈরি করতে হয়। এ কাজ করে জেনারেটর। এই দুই ভোল্টেজ আবার তার দিয়ে যুক্ত থাকে। ফলে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়।

এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, তারে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে গেলে কিছুটা বাধার সম্মুখীন হয়। এই বাধাকে রোধ বলে। এই রোধে বিদ্যুৎ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তার কিছুটা গরম হয়ে যায়। ফলে কিছু বিদ্যুৎ শক্তি তাপশক্তিতে পরিণত হয়ে নষ্ট হয়।

তো বিদ্যুৎ শক্তির একটা একক হল ওয়াট। আমরা ৪০ বা ৬০ ওয়াটের বাল্ব দেখেছি। এর মানে হল এক সেকেন্ডে ওই বাল্ব ৪০ একক পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে। আমরা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করি ইউনিটে। এক ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারের অর্থ হল আমরা এক ঘন্টা ধরে এক হাজার ওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছি।

ধরা যাক, একটা মাঝারি আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষমতা হল ১০০ মেগা ওয়াট বা ১০০,০০০,০০০ ওয়াট। আর সাধারণত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেটরের ভোল্টেজ হয় ১০ থেকে ২০ হাজার ভোল্ট। তো মোটামুটিভাবে আমরা এর থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহ পাব সাড়ে ছয় হাজার একক (১১ হাজার ভোল্ট ধরে হিসাব করা)।

এখন এই বিশাল বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য অনেক মোটা তামার তার দরকার হবে। আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমাদের বাড়ি যদি একশ কিলোমিটার দূরে হয় তবে তার কিনতেই অনেক টাকা ব্যয় হবে। আবার কারেন্ট বা বিদ্যুৎ প্রবাহ যত বেশী হবে তত বিদ্যুৎশক্তির লস বাড়বে। এ বিপদ এড়ানোর জন্য বিদ্যুতের ভোল্টেজ কয়েক গুণ বাড়ানো হয়। আর ভোল্টেজ যত গুণ বাড়বে কারেন্ট তত গুণ কমবে। এই কাজটা করে ট্রান্সফরমার।

তাহলে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ১১ হাজার ভোল্ট থেকে ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে উচ্চ ভোল্টেজে ( ১,৩২,০০০ বা ২,৩০,০০০ বা ৪,০০,০০০ ভোল্ট, এর বেশী এখনো আমাদের দেশে নাই) পরিণত করা হয়। এরপর এই বিদ্যুতকে উঁচু উঁচু টাওয়ারের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।

এখন ধরুন একদিক থেকে ১৩২ কিলো ভোল্ট (১ কিলো = ১০০০) এর লাইন আসল, আরেক দিক থেকে ২৩০ কিলো ভোল্ট এর লাইন। এই দুইটাকে জোড়া দিব কিভাবে? খুব সহজ। মাঝে একটা ট্রান্সফরমার বসিয়ে দেয়া। আর এর সাথে প্রয়োজনে আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন, প্রয়োজনে লাইন বন্ধ করার জন্য সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করা হয়। আর এই পুরো সেটাপকে বলা হয় সাবস্টেশন।

এখন তাহলে সংক্ষেপে বলি, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেটর থেকে ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে উচ্চ ভোল্টেজে বিদ্যুৎকে পরিবহন উপযোগী করা হয়, তারপর তা উঁচু টাওয়ারের সাহায্যে তারের মাধ্যমে দূরে নিয়ে যাওয়া হয়, এরপর সাবস্টেশন দিয়ে এক অংশের সাথে আরেক অংশ যুক্ত থাকে। এভাবে সারা দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অবিচ্ছিন্ন জালে পরিণত হয়। আর একেই জাতীয় গ্রিড বলে।

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা যে কম ভোল্টেজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করি সেটা কোথা থেকে নেই? উচ্চ ভোল্টেজের সিস্টেম এবং এর সাবস্টেশন গুলো থাকে পরিবহন কোম্পানির আওতায়। এখন এদের কিছু সাবস্টেশনে এই ভোল্টেজকে ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে ডাউন দিয়ে ৩৩ হাজার ভোল্টে নামানো হয়। এই লাইন এরপর চলে যায় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির অধীনে। তারা তাদের সাবস্টেশনের মাধ্যমে একে প্রথমে ১১ হাজার ভোল্ট, এভাবে কমাতে কমাতে ২৩০ ভোল্টে ( তিন ফেজে ৪০০ ভোল্ট) আমাদের কাছে পৌছে দেয়।

এরকম কিছু বিতরণ কোম্পানি হল ওজোপাডিকো, ডেসকো, ডিপিডিসি, নেসকো, আরইবির অধীনে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ইত্যাদি। বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইজিসিবি, এনডাব্লিউপিজিসিএল, আরপিসিএল ইত্যাদি। আর একমাত্র পরিবহন কোম্পানি হল পিজিসিবি। উৎপাদন, পরিবহন আর বিতরণ কোম্পানিগুলোর বেশীরভাগই হল পিডিবির আওতাধীন সরকারী কম্পানি। তবে অনেকগুলো বেসরকারী উৎপাদন কোম্পানিও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনে, আর বিতরণ কোম্পানির কাছে বিক্রি করে। বিতরণ কোম্পানি গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল আদায় করে তাদের ব্যবহার্য বিদ্যুৎ অনুসারে। তাহলে পরিবহন কোম্পানি চলে কিভাবে? এরাও বিতরণ কোম্পানির কাছে পরিবহন বাবদ চার্জ আদায় করে। উৎপাদন কোম্পানির টাকা কই যায়? এরা আবার ওই টাকা দিয়ে জ্বালানি কেনে। আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম ঠিক করার দায়িত্ব রয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

এসব তথ্য জানার পর আমরা এবার গ্রিডে বিদ্যুৎ প্রবাহের চ্যালেঞ্জ দেখব। আমাদের প্রশ্ন – কেন গ্রিড বিপর্যয় বা ব্ল্যাকআউট হয়। এ বিষয় বুঝতে আগের পর্বের উদাহরণ সাহায্য করবে ইনশাআল্লাহ।

পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। কিছু লিখি। তারপর আবার মুছে ফেলি। লেখা আর মুছে ফেলার মাঝে কিছু থেকে যায়। সেগুলোর জন্যই এখানে আসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top