আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে গ্রিডে যুক্ত থাকা সবগুলো মেশিন বিদ্যুতের কম্পাংক বা ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক রেখে (স্পিড আর ফ্রিকোয়েন্সির সম্পর্ক আগের আলোচনায় দেখে এসেছি আমরা) বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করে। সেই বিদ্যুৎ বহু পথ পারি দিয়ে আমাদের বাসাবাড়ি বা কারখানায় আসে।
স্বভাবত প্রশ্ন আসতে পারে গ্রিড কি? এর উত্তর জানার আগে আমরা ধৈর্য ধরে নিচের গল্পটি পড়ে নিই।
গ্রামে ধানি জমি গুলো সাধারণত বিশাল এলাকা জুড়ে থাকে এবং রাস্তা বা গ্রাম দিয়ে সাধারণত বিভক্ত হয়। তো ধরা যাক ৪০০ একর ধানি জমি একসাথে আছে। এখন এই জমিগুলোতে সেচের দরকার। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ছোট ছোট শ্যালোমেশিন বসিয়ে নিজের জমিতে পানি দেয়। সাথে আশেপাশের জমিগুলোর পানিও ওই মেশিন থেকে সরবরাহ করে। কেউ আবার ছোট মোটর দিয়ে সেচ দেয়। কিন্তু এগুলো দিয়ে সর্বোচ্চ দুই চার একর জমির পানির চাহিদা মিটে।
তো এলাকার মানুষেরা মিলে সেচ সহজ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে। সরকারি সংস্থা বিএডিসি/বিএমডিসি ওই জমিগুলোর জন্য দুই প্রান্তে দুইটি বড় ডিপ বোরওয়েল (গভীর নলকূপ) বসায়। পুরো সেচ ব্যবস্থা সহজ করার জন্য তারা কয়েকটা কমিটি গঠন করে। এক কমিটি গভীর নলকূপের দেখভাল করবে, এর পানি নিয়ন্ত্রণ করবে। ধরে নিলাম এই পাম্পগুলো স্টার্ট দেয়া কঠিন, আর পানির প্রবাহ কন্ট্রোল করতেও কিছু সময় লাগে যেহেতু আকারে বড়। আর এক কমিটির কাজ ছোট ইঞ্জিনচালিত পাম্প কন্ট্রোল করা।
সবাই সর্বসম্মতিক্রমে নির্ধারণ করল যে পুরো এলাকার জন্য একটা বড় ড্রেন নির্মাণ করা হবে। ছোট বড় সব মেশিন দিয়ে এই ড্রেনে পানি দেয়া হবে। আর এই বড় ড্রেন থেকে ছোট ছোট সাব ড্রেন দিয়ে জমিগুলোতে পানি দেয়া হবে। বড় ড্রেনের জন্য এক কমিটি দায়িত্ব পেল আর ছোট ড্রেনের জন্য আরেক কমিটি।
তো বড় ড্রেনের গভীরতা করা হল ৫ ফুট, প্রস্থ ৭ ফুট আর এতে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে সাড়ে ৪ ফুট পানি সবসময় মেইন্টেইন করা হবে। ছোট ড্রেন গুলো হবে ২ ফুট প্রস্থের তবে এতেও গভীরতা বড় ড্রেনের মত করা হবে। তো এবার সেচ প্রকল্প শুরু হল।
আচ্ছা প্রকল্প শুরুর আগে তো টাকা পয়সা ব্যাবস্থাপনাও করতে হবে, না হলে পরে ক্যাচাল লেগে যেতে পারে। বড় গভীর নলকূপ থেকে কি পরিমাণ পানি আসে তার জন্য ওদের ড্রেনের মুখে মিটার বসানো থাকবে। প্রত্যেক ছোট ড্রেনের মুখে থাকবে মিটার। আর ছোট ড্রেন থেকে প্রত্যেক জমির মুখেও ছোট মিটার বসান থাকবে। সমিতি গভীর নলকূপের কাছ থেকে মাস শেষে পানির পরিমাণ অনুযায়ী বিল পরিশোধ করে পানি কিনবে, আর ছোট ড্রেনের কমিটির কাছে তাদের মাসে নেয়া পানির পরিমাণ অনুযায়ী বিল আদায় করবে। ছোট ড্রেনের কমিটি আবার প্রত্যেক জমির মালিকের কাছ থেকে ব্যবহৃত পানি অনুযায়ী বিল আদায় করবে।
যাই হোক, সেচ প্রকল্প শুরু হল। বিশাল বড় সিস্টেম। ড্রেন তো পানি খুব একটা ধরে রাখতে পারে না। সে সেচ পাম্প থেকে পানি নিয়ে বড় ড্রেন হয়ে ছোট ড্রেনের মাধ্যমে জমিতে দেয়। এখন কোন সময় দেখা গেল জমির পানির চাহিদা বেশী, কিন্তু পাম্প দ্বারা পানি সরবরাহ কম, ফলে ড্রেনের পানির উচ্চতা স্টান্ডারড সাড়ে ৪ ফুট থেকে নেমে ৪ ফুট হয়ে গেল। আবার আরেক সময় দেখা গেল পাম্পের সরবরাহ করা পানি বেশী, কিন্তু জমির পানির চাহিদা কম। ফলে ড্রেনের পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উপচায়ে পড়ার জোগাড়।
এ অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য বড় ড্রেনের সমিতি একটা সাব কমিটি করল। তাদের কাজ হল চাহিদা আর সরবরাহ সমান রাখা। এর জন্য সবার সাথে যোগাযোগ করা। এই পানি প্রবাহ সাব কমিটির সাথে কথা বলে পাম্পের মালিকেরা তাদের পানির প্রবাহ বাড়ায়। আবার ছোট ড্রেন কমিটিও সময়ে সময়ে তাদের পানির চাহিদা বাড়ায় কমায়। তো এতে কিছু সমস্যার সমাধান হল।
অনেক বছর চলে গেল। এর মধ্যে কিছু পাম্প পুরনো হল। নতুন কিছু পাম্প যুক্ত হল। কিছু ড্রেন ভেঙ্গে গেল, সেগুলো সংস্কার করা হলো। আর কিছু আধাভাঙ্গা অবস্থায় থাকল। কিছু কিছু জায়াগায় আইলে ইঁদুর গর্ত করল। বড় ড্রেনেরও কিছু জায়গায় আধুনিকায়ন করা হল। কিছু জায়গায় গভীরতা বেড়ে গেছে, কিছু জায়গায় কমে।
এখন পানি প্রবাহ সাব কমিটির অবস্থা ত্রাহি। মাঝে মাঝে আইল ভেঙ্গে যায়। ফলে হঠাত চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু হুট করে তো আর পাম্প চালানো সম্ভব হয় না। পানির উচ্চতা কমতে থাকে। কমিটি কাছাকাছি থাকা সেচ পাম্পকে উৎপাদনে আসতে বলে। তারা লাইনে আসলে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক হয়। ধরা যাক গভীর নলকূপ লাইনে আনা যেমন কঠিন, তেমনি বন্ধ করাও কঠিন। অন্যদিকে ইঞ্জিন চালিত পাম্প স্টার্ট দেয়া সহজ, কিন্তু এদের সরবরাহ কম। আবার অনেক সময় দেখা যায়, ছোট ছোট ড্রেনের গেট বন্ধ হয়ে যায় হুট করে। তখন আবার পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উপচায়ে পড়ার অবস্থা। দুইদিকেই বিপদ। এই বিপদ সামলে নিয়েই সেচ ব্যবস্থা চালাতে হবে। আর এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কমানোর জন্য ড্রেনেজ সিস্টেম, সেচ সিস্টেম, গ্রাহক সিস্টেম সব আধুনিকায়ন করতে হবে। সাথে দরকার হবে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা। কিন্তু এই গরীব সমিতির পক্ষে তো আর একসাথে সেটা করা সম্ভব না।
সেচের গল্প করতে করতে দেখি বিকাল হয়ে গেল। গ্রিডে তো যেতেই পারলাম না। ইনশা আল্লাহ পরের পর্বে আমরা গ্রিড নিয়ে আলোচনা করব। তবে সেটা বুঝতে হলে এই সেচব্যবস্থাপনা বুঝতে হবে ভালো করে।