বিদ্যুৎ সমাচার – ২

বিদ্যুৎ সমাচার – ২

  ( আমার এ আলোচনা একেবারে প্রাথমিক ধারণা দেয়ার জন্য, অভিজ্ঞরা এড়িয়ে গেলে ভালো হয়। সাথে ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতজ্ঞ থাকব )

ইঞ্জিন হোক আর টারবাইন হোক এগুলো ঘুরানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয় এর স্পিড কন্ট্রোল করতে। অর্থাৎ সেটি প্রতি সেকেন্ডে বা মিনিটে কি পরিমাণ ঘুরবে তা ঠিক রাখতে হয়। জ্বালানি ভিত্তিক টারবাইন বা ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে জ্বালানির প্রবাহ, বাতাসের প্রবাহ, এর পুড়ানোর ফলে উৎপন্ন তাপ এগুলোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসেব করে এগুলো তৈরি করা হয়। বলে রাখা ভালো, একই সাইজের ইঞ্জিন ভিত্তিক জেনারেটরের থেকে টারবাইন ভিত্তিক জেনারেটর থেকে অনেক বেশী বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।

প্রশ্ন আসতে পারে, টারবাইনের স্পিড বা গতি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? এটা বুঝতে গেলে আমাদের বিদ্যুতের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বুঝতে হবে। একে বলা হয় কম্পাংক। ধরেন, আপনার শিশু দোলনায় দোল খাচ্ছে, আর আপনি সেটা গুনছেন। সে একবার দূরে যাচ্ছে, আবার আপনার কাছে চলে আসছে। আপনি হিসাব করে দেখলেন সে মিনিটে ১৫ বার যাওয়া আসা করছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কিছুটা ওরকম। বিদ্যুৎ প্রতি সেকেন্ডে অনেকবার এরকম দিক পরিবর্তন করে। আশ্চর্য লাগলেও সত্য আমাদের দেশের বিদ্যুৎ প্রতি সেকেন্ডে ৫০ বার দিক পরিবর্তন করে । আমেরিকায় করে ৬০ বার। এর মানে এই না যে আমেরিকার বিদ্যুৎ ভালো আমাদেরটা খারাপ। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হওয়ায় এর একতা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে নেয়া হয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে এক বার দিক পরিবর্তন করে আবার আগের দিকে ঘুরে আসলে তাকে বলে এক হার্জ। তার মানে আমাদের দেশের বিদ্যুতের কম্পাংক ৫০ হার্জ।

এখন জেনারেটরের দিকে নজর দেয়ার আগে আমরা কয়েল প্যাঁচানোর ধারণা নিয়ে আসি। মটর বা সিলিং ফ্যানের কয়েল আমরা অনেকেই দেখেছি। তামার বা অ্যালুমিনিয়ামের চিকন তার গুলোকে প্রথমে প্যাঁচায়ে প্যাঁচায়ে এক একটা গ্রুপ করা হয়। তারপর সেগুলো কেসিং এর খাজে ঢুকানো হয়। প্রত্যেকটা গ্রুপ আলাদা থাকে এমন না। এগুলো একটার সাথে আরেকটার কানেকশন থাকে। ধরলাম কয়েলের গ্রুপ কেসিং এর ভিতরের চারদিকে সুন্দর করে প্যাঁচানো। তাহলে সেগুলোর নিজেদের মধ্যে কানেকশন দিয়ে তিনটা ফেজ বের করে নিয়ে আসা হয়।

তিন ফেজের ব্যাপারটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে বলতে পারেন ফ্যানে বা ছোট মটরে দুই ফেজ (আসলে সিঙ্গেল ফেজ) থাকে। হ্যাঁ, দুই ফেজ দিয়েও চলবে, কিন্তু স্টার্ট দেয়া যাবে না। এই সমস্যা দূর করতে এগুলোতে ক্যাপাসিটর ব্যবহার করা হয়। তবে বিদ্যুৎ এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় পরিবহনের ক্ষেত্রে তিন ফেজ সুবিধাটা বেশী পাওয়া যায়, কারণ সেক্ষেত্রে লস কম হয়।

যাই হোক, এই ফেজগুলোকে বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে মোটর বা জেনারেটরের স্পিড কন্ট্রোল করা যায়। তবে এক্ষেত্রে আরেকটু জেনে নেয়া যাক। মটরের ভিতরে যা ঘোরে সেটাকে রোটর বলা হয়। এই রোটর আসলে ঘোরার সময় চুম্বকে পরিণত হয়, যে চুম্বক বিদ্যুৎ থাকলে থাকে, না থাকলে থাকে না। একই ভাবে কয়েল গুলো দিয়েও চুম্বক তৈরি হয়। কয়েলের চুম্বক আর রোটরের চুম্বকের মধ্যে ক্রিয়াকলাপের কারণে মোটর ঘুরতে থাকে। এখন রোটর দিয়ে যদি আমি একটা দুই মাথাওয়ালা চুম্বক তৈরি করি তাহলে প্রতি মিনিটে মটর ৩০০০ বার ঘুরবে। আর চার মাথাওয়ালা চুম্বক তৈরি করলে প্রতি মিনিটে ১৫০০ বার ঘুরবে। তবে এখানে মটরে যে কারেন্ট সাপ্লাই দিচ্ছি তার কম্পাংক হতে হবে ৫০ হার্জ।

জেনারেটরের ক্ষেত্রে উলটো কেস। জেনারেটরে তো ভিতরের রোটর ঘুরায়ে কয়েলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। সেক্ষেত্রে যদি দুই মাথাওয়ালা চুম্বক (রোটর) প্রতি মিনিটে ৩০০০ বার ঘুরাই তাহলে তারে ৫০ হার্জের বিদ্যুৎ পাব। আর ১৫০০ বার ঘুরালে চার মাথার চুম্বক বিশিষ্ট রোটর লাগবে।

আর এই রোটরকে ঘুরানো হয় টারবাইন দিয়ে। তাই ৫০ হার্জ এর বিদ্যুৎ পেতে টারবাইনকে ঘুরাতে হবে মিনিটে ৩০০০ বার। এখন এটা তো একটা ভারী জিনিস। একে এত সূক্ষ্মভাবে ঘুরানো তো মুশকিল। ফলে এই স্পিড কিছুটা উঠানামা করে। যখন ৩০৬০ হয় তখন বিদ্যুৎ পাই ৫১ হার্জে। আর ২৯৪০ হলে পাই ৪৯ হার্জ।

মজার ব্যাপার হল যতগুলো জেনারেটর আমাদের গ্রিডে বিদ্যুৎ সাপ্লাই দেয় সবগুলো প্রায় একই স্পিডে ঘুরতে থাকে। আর এই সবগুলো মেশিন কিভাবে এটা মেইন্টেইন করে সেটা সুযোগ পেলে ইনশাআল্লাহ সামনে দেখব।

পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। কিছু লিখি। তারপর আবার মুছে ফেলি। লেখা আর মুছে ফেলার মাঝে কিছু থেকে যায়। সেগুলোর জন্যই এখানে আসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top