জুতোজোড়া

জুতোজোড়া

 অফিস থেকে লাঞ্চের পরপর ফিরে আসল রুহুল। আজ বৃহস্পতিবার। কাল – পরশু ছুটি আছে। এই দুদিনে এদিকের ঘরগুলোর সব জিনিসপত্র ওদিকের ঘরটায় রাখতে হবে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দিতে হবে। অনেক কাজ।

কয়েক বছর ধরেই হাল আমলের এই ঘরগুলো ভেঙ্গে নতুন নকশায় বিল্ডিং করার প্লান করছিল সে। সময় করে উঠতে পারছিল না। কিন্তু এখন আর না করলেই নয়। অন্তত দুইটা ফ্লোর কমপ্লিট করতে হবে।

একেবারে রাস্তার পাশের ছোট ঘরটা অনেকটা স্টোররুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাই বলে ভাঙ্গা চোরা জিনিস না। একদিকে মাঝে মাঝে দরকার হয় এমন অনেক জিনিস রাখা। আর একেবারে পশ্চিম দেয়ালের দিকে রাখা কিছুটা স্মৃতিময় জিনিস। ওখানে যে সাইকেলটা আছে ওটা বাবা ক্লাস টু তে কিনে দিয়েছিলেন। তার পাশে দুটো ক্ষত বিক্ষত ফুটবল, একটি পুরনো আমলের ক্রিকেট ব্যাট। বলতে গেলে সব স্মৃতির আখড়া।

আজ সে যে মিশনে নেমেছে তাতে স্মৃতিকে আজ পাত্তা দেয়া যাবে না। এসব স্মৃতিকেও দুই ভাগে ভাগ করে ফেলতে হবে। ফেলে দেয়ার যোগ্য স্মৃতি, আর ফেলে দেয়া সম্ভব না এমন স্মৃতি। এই যেমন – ভাঙ্গা হারিকেন, এটাকে ফেলে দেয়া স্মৃতি ক্যাটাগরিতে ফেলা ছাড়া উপায় নাই। সব কিছু রাখার জায়গা নাই।

স্মৃতিময় জিনিসপত্র হবার কারণে কাজ অনেক স্লো আগাচ্ছে। কারণ ক্যাটাগরি সিলেকশনে সময় লাগছে। মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে তার শৈশবে।

এর মধ্যে তার ক্লাস থ্রিতে পড়া ছেলে জিজ্ঞেস করল, বাবা, এই স্যান্ডেল জুতোজোড়া কি ফেলে দিব?

রুহুল সেদিকে তাকাল। ওগুলো তার বাবার জুতো। সে তখন টু কি থ্রিতে পড়ত। সেবার সে পরীক্ষায় অনেক ভালো করল। কি মনে করে বাবা বললেন, বল, কি চাস তুই?

রুহুল সাধারণত কিছু চাইত না। কি মনে করে সে বলে ফেলল, বাবা আমাকে ভালো এক জোড়া জুতো কিনে দাও!

ওদের তখন বেশ অর্থকষ্ট। সে ছোট মানুষ হলেও এটুকু বুঝত। বাবা তাকে জুতোর দোকানে নিয়ে গেলেন। সে জুতো দেখিয়ে দিলে দোকানদার জুতো বের করল।

জুতোজোড়া ছিল বেশ দামি। বাবা দোকানদারকে জুতোর দাম জিজ্ঞেস করল, তারপর অন্য জুতো দিতে বললেন। রুহুল অবশ্য খুব বেশী আপত্তি করল না। তার বাবা নিজেও এক জোড়া স্যান্ডেল কিনলেন।

বাবা ছেলে দুই জনই নতুন জুতো পড়ে হাঁটতে লাগলেন। রুহুল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা, তুমি কাঁদছ কেন?

তার বাবা কান্না লুকানোর চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, কই কাঁদছি না তো, এই একটু পোকা পড়েছে।

এর বছর দুয়েক পরেই রুহুল তার জুতো হারিয়ে ফেলে। জুতো রেখে খেলতে নেমেছিল, পরে সেখান থেকেই হাওয়া।

তার বাবা স্যান্ডেল জোড়া অনেক দিন পড়েছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর সেগুলোর স্থান হয় এই ঘরের এক কোনায়।

আজ এত বছর পর তার ইচ্ছা হল বাবার জুতো জোড়া পড়ে দেখতে। সেগুলো পায়ে দিল সে। আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করল সেগুলো ঠিক তার পায়ের মাপের। আশ্চর্য এক শিহরণ বয়ে গেল তার শরীরে।

এখন সে তার বাবার জায়গাটা বুঝতে পারে। তার বাবার কাজকর্ম, তার চেষ্টা, তার আচরণ, অনুভূতিগুলো সে অনুভব করতে পারে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে আলাপ করতে পারে না। আজ এই পরিণত বয়সে উপনীত হয়ে কাঠখোট্টা এক দুনিয়া দেখে। তার একসময়ের রঙ্গিন দুনিয়া রং হারাতে হারাতে আজ ধূসর হয়ে গেছে। সে এখন তার সন্তানের চোখে রঙ্গিন দুনিয়া দেখতে পায়। তার খুব ইচ্ছে হয় তার বাবাকে জিজ্ঞেস করতে, বাবা, তোমাকে এখন আমি বুঝতে পারি।

কি অদ্ভুত নিয়ম এই জগতের। ছোট ছোট পা আস্তে আস্তে বড় হয়। বড়রা দুনিয়ার এই কাঠিন্যতা তাদেরকে বুঝতে দেন না। এক সময় তারা অগ্রগামীদের জুতোয় নিজেদের পা আবিষ্কার করে। কিন্তু তাদের খুঁজে পায় না। হঠাত পেছন থেকে আরেকটা কণ্ঠ ভেসে আসে, বাবা, তুমি কাঁদছ কেন?

পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। কিছু লিখি। তারপর আবার মুছে ফেলি। লেখা আর মুছে ফেলার মাঝে কিছু থেকে যায়। সেগুলোর জন্যই এখানে আসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top