পায়ে খেলার ফুটবলটা হাত দিয়ে বাউন্স করাতে করাতে ভাঙ্গা ব্রীজটা পার হয়ে খেলার মাঠটায় পৌছাল ওরা। প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেলে ওরা জড় হয়। এদের অনেকে সবে স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকবে ঢুকবে করছে। কয়েকজন আছে স্কুল পড়ুয়া। আর কয়েকজন বেকার যুবক।
ইটভাটার পাশের এই খোলা মাঠটায় খেলা চলে। তবে সব মৌসুমে খেলা যায় না। এইত আর দশ বারোদিন পরেই হয়ত ইট কাটা শুরু হয়ে যাবে। তখন এদেরই কয়েকজন ইট কাটার কাজে লেগে পড়বে। ওই সময়টায় খেলা হয় মসজিদের পাশে ফেলনা যে জমিটা আছে ওটায়।
আজ অবশ্য এখনো সবাই এসে পৌছায় নি। চৌদ্দজন দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে নিল। আর অপেক্ষা করা যায় না। বাকিরা আসুক, তখন দেখা যাবে। এখন খেলা শুরু না করতে পারলে শেষ করতে করতে অন্ধকার হয়ে যায়। তখন বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেকের অন্য কাজের ব্যাঘাত ঘটে। ছোটরা বাড়িতে বকা খায়।
মাঠের মাঝখানে বলটায় লাথি দিতে যাবে এমন সময় পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিমের সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে হোসেন। ওকে বিরতিহীনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বাকিরাও ওর চোখকে অনুসরণ করে। কেউ একজন আসছে। একটু দূরে হওয়ায় আর সূর্যের আলোর ঝলকানিতে মুখটা পরিষ্কারভাবে দেখতে না পেলেও চিনতে অসুবিধা হয় না ওদের। সাথে সাথেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! আরে আনিস না!
আনিস ছিল ওদের স্কুলের হেড মাস্টারের ছেলে। সবসময় হাসিখুশি মুখে থাকত। আর যে কোন ভালো কাজে ছিল সবার আগে। ফুটবল টিম সাজাতে হলে আনিসকে মাঝমাঠে রাখতেই হবে। ওকে ছাড়া দল কল্পনাও করা যাবে না। আজ কতদিন পর ওকে দেখছে হোসেন! সেই হাসিমুখ! মুখভরা দাঁড়ি। মাথায় গোল টুপি। গায়ে জোব্বা!
হ্যাঁ, এটা আনিসই। ভুল করার প্রশ্নই ওঠে না। আনিস কাছাকাছি আসতেই হোসেনের মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, কেমন আছিস রে?
আনিসের মুখ থেকে যেন মুক্তা ঝরে পড়ে, আল্লাহর রহমতে আগের যে কোন সময়ের থেকে ভালো আছি! কোন দুঃখ কষ্ট নাই। তোদের কি অবস্থা?
হোসেন উত্তর দেয়, আছি আগের মতই। দেখতেই তো পাচ্ছিস! ফুটবল, এটা, ওটা এভাবেই জীবন কেটে যাচ্ছে!
আনিস এবার জিজ্ঞেস করে, সেটা বুঝলাম! তাই বলে কোন পরিবর্তন হবে না? আসরের নামাজ পড়েছিস?
হোসেন না বোধক উত্তর দেয়ায় আনিস ওর হাত ধরে টানতে থাকে। চল মসজিদের দিকে যাই।
ওরা দুজন এগিয়ে যায়। বাকিরা কেন জানি আসে না। হোসেন অবশ্য তা খেয়াল না করে আনিসের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকে।
আনিস বলতে থাকে, আমার থেকে কিছুই শিখলি না তোরা?
হোসেন বলে, আসলে ব্যাপারটা তা না। তুই চলে যাবার পর ওই কয়েকদিন আমরা সবাই অনেক ভেবেছিলাম। তুই যে এরকম হঠাত গায়েব হয়ে যাবি এ ব্যাপারটা বুঝতে পারি নি। আমরা কয়েকজন পরিপূর্ণ নামাজি হয়েছিলাম। তারপর সময়ের সাথে আবার আগের মত হয়ে গেছি। এমনকি তোর মাঝমাঠের জায়গাটাও আরেকজন দখলে নিয়ে ফেলেছে।
আনিস মুচকি হাসে। তারপর বাঁ দিকে দূরের তালগাছটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, আসলে জীবনের সব থেকে বড় সত্য কি জানিস? মৃত্যু। মৃত্যু আসে জীবনকে পূর্ণতা দিতে। কিন্তু মানুষ বেশীরভাগ সময় হতাশ করে তাকে।
আসলে ব্যাপারগুলো শুধুমাত্র বিশ্বাসের না। এগুলো দৃঢ় বিশ্বাসের। এগুলো ইয়াকিনের, আনিস বলতে থাকে।
এই যেমন আমাদের জীবন যাপনের কথাই চিন্তা কর। বর্তমান বিশ্ব ব্যাবস্থায় হিউম্যানিজমের কথা বলা হচ্ছে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ বেশীরভাগ সময় ধর্মকে ভিলেন বানানো হচ্ছে। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’, এই কথাগুলো ব্যাপকভাবে বলা হচ্ছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মকে একটা গৌণ ব্যাপার বানানো হয়েছে। ধর্ম নিয়ে যারা বাড়াবাড়ি করে, ওরা হইল খ্যাত।
এই যেমন ভার্সিটির ছাত্রদের দিকে তাকা। তুই টিশার্ট পড়ে আছিস, কন্সার্টে ঢুকে গেলি। ছেলে মেয়ে সবাই মিলে কত রাত জেগে খাটাখাটুনির পর একটা প্রোগ্রাম আয়োজন করেছে। সবাই মিলে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং। তারপর মাগরিবের আজান দিল, কয়েকজন বের হয়ে মসজিদে ঢুকে গেলি। কোনমতে নামাজটুকু পড়েই আবার প্রোগ্রামে। একসাথে সবকিছুই হচ্ছে। হারাম প্রোগ্রাম, ফরজ নামাজ!
হোসেন আনিসের মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। এক নিদারুণ মোহময় বলার ভঙ্গি।
এই মিকচারড জীবনের একটা খুত আছে। আমরা আসলে মূর্খতার কারণে এমন গুবলেট পাকানো ইসলামে ঢুকে যাচ্ছি। কিংবা আমাদেরকে ঢুকানো হচ্ছে।
তো ইসলামের বিষয়গুলো নিয়ে একটু চিন্তা করে দেখ। এটা একরম মিকচারে কাজ করে না। ইসলামের বেসিক হল ঈমান। কেউ একটা কিছু তোকে এসে বলল, তুই বিশ্বাস করলি। এটা বিশ্বাস হল, ইয়াকিন না। কোন কিছু ইয়াকিন করার অর্থ হল, ওই বিষয় তুই নিশ্চিত জ্ঞান হিসেবে ধরে নিয়েছিস। এর জন্য তোকে নিজেকেই যে দেখতে হবে, সেটা জরুরি না।
এই নিশ্চিত জ্ঞান তুই নিজে তোর ইন্দ্রিয় যেমন – চোখ, কান এসব দ্বারা যেমন অর্জন করতে পারিস, তেমনি তোর বুদ্ধি খাটিয়ে বুঝতে পারিস। আর একটা উপায় হল তোর বিশ্বাসযোগ্য কেউ যদি এসে খবর দেয়। বিজ্ঞানীদেরকে আমরা বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নেই বলেই, সূর্যের চারপাশে গ্রহ নক্ষত্র ঘোরে, সূর্য এত দূরে আছে এসব তথ্য বিশ্বাস করি। তাদেরকে বিশ্বাস করার আরেক কারণ হল আমাদের চারপাশে আমরা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে তৈরি করা অনেক প্রযুক্তি দেখি।
একইভাবে, বিভিন্ন সময় নবী রাসুলরা এসেছেন, তাদেরকে লোকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করতে আল্লাহ তাআলা মুজিযা দিয়েছেন। তারা আল্লাহর অনুমতিতে অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখিয়েছেন। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক মুজিযা ছিল। এছাড়া নবুওয়্যাত প্রাপ্তির পূর্বেই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে বিশ্বাসী বলে ডাকত। তাঁর কোন শিক্ষাদীক্ষা ছিল না। আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে আল কুরআন পাঠিয়েছেন। এটা সবচেয়ে বড় মুজিযা। কুরআন অর্থসহ একবার পড়, নবীজির জীবনি একবার পড়, দেখবি ক্লিয়ার হয়ে গেছে।
তো নবীজি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে অন্য নবীদের ধারাবাহিকতায় আল্লাহ তাআলার একত্ববাদের কথা বলেছেন। এর সাথে আমরা আমাদের বুদ্ধি খাটিয়ে আমাদের চারপাশের সৃষ্টিজগত দেখি, অণু পরমাণুর ভিতরের অতি ক্ষুদ্র কণা থেকে শুরু করে গ্রহ নক্ষত্র, গ্যালাক্সির কথা চিন্তা করি, শরীরের একটি কোষের অভ্যন্তরের কথা ভাবে, এসব জিনিসের শৃঙ্খলা নিয়ে ভাবি, সৃষ্টিজগতের একটা বস্তুর উপর আরেকটার নির্ভরতার কথা উদারতার সাথে ভাবি তাহলে বুঝতে পারি আল্লাহ তাআলা আমাদের একমাত্র রব, একমাত্র ইলাহ।
তো আল্লাহ আল্লাহ তাআলাকে আমি একমাত্র ইলাহ, নবীজিকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে মেনে নিলে ঈমানের বাকি বিষয়গুলো মেনে নেয়া আবশ্যিক হয়ে যায়। মৃত্যু যেমন পরম সত্য, একইরকম সত্যরুপে কিয়ামত, আখিরাতের জীবন আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হবে। এই বিষয়গুলো তখন আমাদের কাছে হবে নিশ্চিত জ্ঞান, এগুলোর প্রতি ইয়াকিন তৈরি হবে, এগুলো আমাদের আকীদার ভিত্তি রচনা করবে।
আর এসব আকীদাই আমাদের কর্ম নিয়ন্ত্রণ করবে, আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে। আমার সামনে কেউ যদি এক গ্লাস পানিতে একটু করা বিষ মিশিয়ে দেয়, তাহলে আমরা ঐ পানি পান করব না। কারণ ওই বিষের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের ইয়াকিন আছে। আর জাহান্নামের আযাবের সাথে তো এর কোন তুলনাই চলে না। অথচ তা আমরা তেমন ভয় পাই না।
একবার যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আমাদের ইয়াকিন তৈরি হবে তখন তাদের আদেশ নিষেধ আমাদের কাছে হতে হবে চূড়ান্ত। তারা যে বিষয়ে ভয় দেখাবেন, সেটা অবশ্যই ভয় পাওয়ার যোগ্য। তারা যেটাকে আশা দেখাবেন, সেখানে অবশ্যই আশা আছে। তাই কুরআন হাদিস থেকে উৎসারিত প্রতিটি আদেশ নিষেধই হবে আমাদের কাছে শিরোধার্য।
এই লম্বা লেকচার শুনে এতক্ষণে বোরিং লাগার কথা হোসেনের। অতীতে মসজিদের ইমাম সাহেব অনেকবার বলার চেষ্টা করেছেন, প্রত্যকেবারই এড়িয়ে গেছে সে। আজ কেন জানি প্রতিটি কথা তার অন্তরের গহীনে গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। আর তার কর্ণকুহরে তৈরি হচ্ছে আরও শব্দ গ্রহনের হাহাকার।
সেই হাহাকার পূর্ণ করতেই কি না, আনিস বলেই চলল। সে বলল, আল্লাহ তাআলাকে ইলাহ জানার পর, সুনিশ্চিত মৃত্যুর অনিশ্চিত সময় জানার পর, হাশরের ময়দানে হিসাবের কথা জানার পরও আমরা ইগ্নোর করে চলে যাই। এমনভাবে চলতে থাকি যেন এসব কিছুই নেই। বর্তমান সমাজের চলমান স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা স্মার্ট হতে চাই। জোকের মত একটা পুঁজিবাদী অসাম্য অর্থনীতির প্রেমে হাবুডুবু খাই। পশ্চিমের চাকচিক্যে আমাদের চোখ ধাধিয়ে যায়, আমরা পোকার পালের মত আগুনে ঝাপ দিতে থাকি। এক মহাসত্যকে উপেক্ষা করে স্রোতের বিপরীতে চলার কষ্টের ভয়ে আমরা গা ভাসিয়ে দেই সাময়িক আরামে। কে চায় সমাজের চোখে হঠাত সন্দেহভাজন হতে! তার থেকে এ কাজেও থাকি ওটাতেও থাকি।
এ পর্যন্ত বলে আনিস থেমে যায়। একই সাথে থেমে যায় তার পদযুগল। তার দেখাদেখি হোসেনও থেমে যায়। জোড়াপুকুরের এ মাথায় গাছগাছালির আধিক্য থাকায় হঠাত যেন অন্ধকার নেমে আসে বলে মনে হয়।
হোসেন পিছনে ফিরে তাকায়। না সন্ধ্যা হয় নি এখনো। আনিস হঠাত বলে উঠে, ওপারের জীবনটা অনেক ছোট্ট রে! আর কত এর মোহে পড়ে থাকবি?
একথা শুনে হোসেন যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। আরে তাই তো!
এ তো তার বন্ধু আনিস! তাড়াহুড়ো করে সে সামনে তাকায়। আনিসকে খুঁজে ফিরে তার চোখ। খুঁজে পায় না। তার চোখে অশ্রুর বন্যা নামে। এসময় আজানের ধ্বনি ভেসে আসে।
হোসেন চোখ খুলে তাকায়। বিছানায় শুয়ে আছে সে। ঘরের ছাদের নিচে দেয়ালে রাখা ফুটো দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো এসে মশারির উপর পড়ে এক অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি করেছে যেন।
হোসেনের চোখে অশ্রুর বন্যা এখনো বয়ে চলছে। আনিস তার বাল্যবন্ধু। ইন্টারমিডিয়েটের পর ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে শহরে চলে যায়। প্রথম বছর ঠিকঠাকই ছিল। এরপর হঠাত বদলে যায়। তার ক্লিন শেভড মুখ দাঁড়িতে ঢেকে যায়। মাঝে একবার জানায়, কুরআনের হিফয শুরু করেছে সে।
সেবার আনিসের লাশটা যখন লাশবাহী গাড়ি থেকে নামানো হয় সেটা ধরতে গিয়েও যেন ধরতে পারে নি হোসেন। হঠাত তার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গিয়েছিল। আর চোখ দিয়ে সেদিন নেমেছিল আষাঢ়ের স্রোতধারা।
দ্রুত বিছানা থেকে নেমে অজু করে মসজিদে ফজরের জামাতে শরীক হয় সে। নামাজ পড়ে বাড়ির দিকে ফিরতে গিয়েও ফিরে না সে। উল্টোদিকে হেঁটে জোড়াপুকুরের পাড়ে চলে যায়। ঘন গাছগুলোর নিচে অন্ধকার জায়গাটায় আনিসের কবরের পাশে গিয়ে দাড়ায়। মাত্র তিন বছরেই মাটি প্রায় সমান হয়ে গিয়েছে।
সেখানে বসে কবরের অল্প কিছু মাটি হাতে নিয়ে চাপ দিয়ে গুড়ো করে সে। কত সুন্দর দেহ কিসের সাথে মিশে যায়। পিছনে পড়ে থাকে অদ্ভুতুড়ে এক দম্ভ আর অহংকার।
আনিস উঠে দাড়ায়। পূর্বদিকে গাছ গাছালির ফাক দিয়ে সবেমাত্র উদিত হওয়া সূর্যকে উকি দিতে দেখা যায়। তার জীবনেও যেন এক সূর্য জাগিয়ে দিয়েছে আনিস। এ সূর্যকে অস্ত যেতে দিবে না সে। দরকার হলে আল্লাহর দরবারে বান ডাকবে তাঁর অশ্রুভেজা চোখ।