ইন্টারে পদার্থবিদ্যায় বল, সরণ, কাজ, শক্তি এসব নিয়ে কয়েকটা অধ্যায় ছিল। বেসিক অনেকটা এরকম। কোন বস্তুর গতি বা গতির দিক পরিবর্তনের জন্য তার উপর কোন এক দিকে বল বেশী প্রয়োগ করতে হবে। বল প্রয়োগ করে বস্তু যদি সরে যায় তবে কাজ হবে। আর কাজ হলে শক্তির পরিবর্তন হবে। এই শক্তি হয় বস্তু থেকে চলে যাবে অথবা বস্তুর মধ্যে জমা হবে।
এখন বলের ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করি। ধরুন, দুই বন্ধু রাসেল আর শান্ত একটা বই নিয়ে টানাটানি করতেছে। স্বভাবত যার জোর বেশী বই সেদিকে যাবে। এটাকে এভাবেও বলা যায়, যার জোর বেশী সে আরেকজনের বলের থেকে বেশী বল প্রয়োগ করতে পারবে। তাই বই তার দিকে সরে যাবে। এখানে দুইজনের বল সমান হলে বই কারও দিকে যেত না। অর্থাৎ বই তার আগের স্থির অবস্থায়ই থাকত।
আমরা যদি কোন কিছু স্থির অবস্থায় দেখি তাহলে বুঝে নিব এর উপর কোন বল একদিকে কাজ করলে, তার সমান আরেকটা বল উল্টাদিকে কাজ করতেছে। তাই বস্তু স্থির অবস্থায় আছে। আরেকটা উদাহরণ দেই, সব বস্তুর উপর পৃথিবীর একটা টান আছে, এটাকে অভিকর্ষ বল বলে। একটা বই যদি হাতে ধরে থাকি, সেক্ষেত্রে বই এর উপর পৃথিবী যে টান দেয়, আমি বইটাকে স্থির অবস্থায় ধরে রাখতে ঠিক সমান বল পৃথিবীর টানের উল্টাদিকে অর্থাৎ অভিকর্ষের উল্টাদিকে দেয়া লাগছে।
উপরের তিন প্যারা পড়ে কেউ ভাববেন না আমি পদার্থের ক্লাস নিতে বসেছি। আমি শিক্ষক না, তাই এসব ক্লাস আমাদের জন্য না। উপরের উদাহরণগুলো আনলাম আমাদের জীবনে প্রয়োগ করব বলে।
আমরা সবাই সমাজে বাস করি। সমাজের অন্যান্য সদস্যদের কাছে আমাদের প্রত্যেকের একটা ইমেজ আছে। যেমন- একজন টিপিক্যাল ইন্টারের গুড বয়ের ক্ষেত্রে সমাজের লোক জানে, এই ছেলেটা ভদ্র। কলেজে ঠিকমত যায়, কাউকে গালি দেয় না। বিকেলে খেলাধুলা করে। নামাজেও দেখা যায়। বেশী রাতে বাইরে যায় না। বেশীরভাগ সময় টি শার্ট বা শার্ট পরে। চুল স্বাভাবিকভাবে কাটে। ইত্যাদি ইত্যাদি। একজন ফাঁকিবাজ বখাটের ক্ষেত্রে মানুষের ইমেজ অন্যরকম।
বখাটে ছেলেটাকে নিয়মিত কলেজে যেতে দেখলে অবাক হবে, টিটকারিও মারতে পারে। নামাজ না পড়া ছেলেটা নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করলে কানাঘুষা শুরু হবে। ভালো ছেলেটা হঠাত চুল স্টাইলিশ করলেও মানুষ অবাক চোখে তাকাবে। রাতে বাইরে মাঝে মাঝে দেখা গেলে দুই তিনদিন পরেই বাড়িতে রিপোর্ট চলে যাবে। হঠাত দাঁড়ি রাখলে তো আর কথাই নেই। সবাই অন্যরকম ভাবে তাকাবে। কলেজে ঠিকমত না গেলে হয়ত শিক্ষকেরা খোঁজ নিবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই যে আমাদের চারপাশে সমাজের লোক, পরিবারের সদস্য – এদের কাছে আমাদের প্রত্যেকের কাছে একটা ইমেজ আছে। আমরা বুঝি আর না বুঝি, এরা প্রত্যেকে আমাদের উপর বিভিন্ন বল প্রয়োগ করে, তা হতে পারে অদৃশ্য। যেমন আমি এটা করলে লোকে কি বলবে, ওইটা পড়লে লোকে কি বলবে, এই লজ্জাও একটা বল হিসেবে কাজ করে । এই অদৃশ্য বলের কারণে নিয়মিত পাঞ্জাবি পড়া লোকটা যেমন হঠাত টি শার্ট পড়ে বাজারে যেতে পারে না, তেমনি নিয়মিত টিশার্ট পড়া ছেলেটা হঠাত জোব্বা পড়া শুরু করতে পারে না। অর্থাৎ সমাজের এসব অদৃশ্য বল আমাদেরকে আমাদের ইমেজে প্রায় স্থির অবস্থায় ধরে থাকে। অর্থাৎ আমরা সাম্যাবস্থায় থাকি।
এবার আরেকটা উদাহরণ দেই। পুকুরের স্থির পানিতে ঢিল ছুড়লে ঢেউ সৃষ্টি হতে থাকে, কিন্তু এই ঢেউ খুব বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঢেউয়ের উচ্চতা আস্তে আস্তে কমতে কমতে একসময় আবার আগের অবস্থায় স্থির হয়ে যায়। একটা ছোট বস্তুকে রাবার দিয়ে বেঁধে তার আরেক মাথা কোথাও টান দিলে বুঝা যায় যে বিপরীত দিকে আরেকটা বল তৈরি হয়েছে, ছেড়ে দিলে আগের অবস্থানে চলে যাবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের চারপাশের প্রকৃতিকে এমনভাবেই তৈরি করেছেন। যেন সবকিছু সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে চায়। আমাদের মস্তিষ্কও বেশীরভাগ সময় স্থিরতা চায়, হঠাত পরিবর্তনকে মেনে নিতে চায় না। আমাদের সমাজও চায় তার স্থির অবস্থা, সবাই যেন তার ইমেজ বজায় রাখে।
অনেক সময় আমাদের অন্তরে বুঝ আসে, আমরা জীবনে একটা পজেটিভ পরিবর্তন চাই। সেটা হতে পারে কারও বয়ান শুনে কিংবা হঠাত পাওয়া কোন শকে। আমরা ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারি আমাদের জীবনে পরিবর্তন দরকার। আমাদের চিন্তা চেতনায় যেমন পরিবর্তন দরকার, তেমনি সেই পরিবর্তনকে বজায় রাখতে কর্মে, জীবনাচারে পরিবর্তন দরকার।
কিন্তু এসব পরিবর্তন আনতে গেলে সমাজে আমাদের ইমেজে পরিবর্তন আসবে, আর স্বভাবত সমাজব্যবস্থায় এর বিপরীত একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। এই প্রতিক্রিয়া চাবে আমাদের পরিবর্তনের ঢেউকে মিইয়ে দিয়ে স্থির পানির মত করে দিতে।
এক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময় আমাদের অভ্যন্তরীণ শক্তি থাকে দুর্বল, আর এই দুর্বল বল দিয়ে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া বলকে ডিঙ্গিয়ে পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। মজার ব্যাপার হল অভ্যন্তরীণ শক্তি বেশী হলে, এসব বাধা পরিবর্তনকে আটকাতে পারে না। রাবার দিয়ে আটাকানো বস্তুকে বেশী জোরে টান দিলে রাবার ছিঁড়ে চলে আসবে। পৃথিবীর টানকে উপেক্ষা করে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাতে হলে অভিকর্ষ বলের বিপরীতে প্রচুর বল প্রয়োগ করতে হবে, আর এর জন্য প্রয়োজন হবে প্রচুর জ্বালানি শক্তি।
কাজেই আমাদের শক্তি অর্জন করতে হবে। ফিতনার এই যুগে আমাদের পরিবেশ, আমাদের সমাজ চাবে অভিকর্ষ বলের মত আমাদেরকে ভুমির দিকে ফিরিয়ে আনতে। আর এই বাঁধা ডিঙ্গাতে হলে প্রয়োজন ঈমানী শক্তি, অনেক ধৈর্য আর কষ্ট সহ্য করার মানসিকতা। এ শক্তি অর্জনের জন্য শক্তির উৎসের কাছে যেতে হবে। অনলাইনে এবং অফলাইনে। অনলাইনে উলটাপালটা পোষ্টকারী ব্যক্তিদের আনফ্রেন্ড বা আনফলো করতে হবে। আর দ্বীনি খেদমতকারী পোস্ট ভিডিও ইত্যাদি যারা দেন তাদের ফলো করতে হবে। মসজিদে আগে আগে গিয়ে খুতবা শুনতে হবে। অনলাইনে ভালো আলেমের বয়ান শুনতে হবে। মাদ্রাসা, বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে নিয়মিত যেতে হবে। ভালো আলেম, পীর অথবা দ্বীনি বড়ভাই যারা ভালো বুঝেন তাদের কাছ থেকে যা বুঝি না বুঝে নিতে হবে। দ্বীনি বই, পত্রিকা বেশী বেশী পড়তে হবে। কুরআন হাদিস পড়তে হবে, ইসলামের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে, প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করতে হবে। আধুনিক বিশ্বের ফিতনা বুঝতে হবে, দ্বীন থেকে এ সিস্টেমের বিচ্যুতি জেনে নিতে হবে। ফোন চার্জে না দিয়ে যেমন ফোনে চার্জ আশা করতে পারি না তেমনি দ্বীনি এসব উৎস উপকরণ ছাড়া এমনি এমনি আমাদের জীবনে দ্বীন আসবে এটা আশা করাও বোকামি।
আর দুয়া করতে হবে আল্লাহ তাআলার কাছে। এটা একটা বড় শক্তি। এই শক্তি আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারি না। এর সাথে সাথে আমাদের চেষ্টা করতে হবে।
রকেট যেমন অভিকর্ষের বাঁধা পেরিয়ে মহাশূন্যে একবার পৌঁছে গেলে আর খুব একটা জ্বালানি লাগে না, শুধু ঐ অবস্থা মেইনটেইন করলেই হয়, তেমনি আমাদেরও প্রাথমিক বাঁধা কাটিয়ে উঠতে হবে। একবার পুরাতন ইমেজ ঘুচিয়ে নতুন ইমেজ তৈরি করতে পারলে তখন বাধা কমে যাবে। এই প্রসেস চলতে থাকবে, অল্প অল্প করে বাধা কাটিয়ে আমরা আদর্শ ইসলামী ইমেজ অর্জন করব। পুরাতন সাম্যাবস্থা সরে গিয়ে তৈরি হবে নতুন একটি সাম্যাবস্থা যা হবে আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবার মধ্যে প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে দিন, সমস্ত বাধা ঠেলে নতুন সাম্যাবস্থায় পৌছার তৌফিক দিন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাতে স্থিরতা দান করুন। আমিন।