এই তপু!

এই তপু!

 (জহির রায়হানের একুশের গল্প এর আদলে কিছু সত্য বেশী কল্পনার মিশ্রণে লেখা)

তপুকে আবার দেখতে পাব ভাবি নি।

সেই তপু! আমাদের তপু! আমার রুমমেট।

আমার

এক বছরের জুনিয়র। হাসিখুশি মুখ। মাড়ির কাছাকাছি উপরের এবং নিচের দুইটা দাঁতই বাঁকা। হাসলে খারাপ লাগার কথা। অথচ হাসলে সুন্দরই লাগত।

তপুকে আমি অসম্ভব পছন্দ করতাম। এর অনেকগুলো কারণ আছে। হলে যখন আসল, আমরা তখন কিছুটা থিতু হয়ে গেছি। প্রথমদিকে ভার্সিটি নিয়ে একরকমের অসম্ভব উচ্চাশা থাকে – সেটা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। তখন অনেকটাই নিয়মতান্ত্রিক জীবন। টীপিক্যাল নরমাল গুড বয় আমরা। ক্লাস করি, টিউশনিতে যাই। আড্ডা দেই। পরীক্ষা প্রস্ততির সময়গুলোতে রাত জেগে পড়ি। মধ্যরাতে খেতে যাই। এই আর কি।

যখন আমরা কেবল এসবে নরমালাইজড হচ্ছি ঠিক তখনই ঠোঁটের কোনায় হাসি নিয়ে সে হাজির। গ্রামের ছেলে, পড়েছে জেলা শহরে। তার মানে মেসের ডালে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে এসেছে। এখন প্রথম কয়েকদিন হলের ডাল তার কাছে অমৃত লাগবে।

তপুর আলাদা কোন গুণ কিনা জানি না, এসেই খুব সহজে আমাদের সাথে মিশে গেল। আমার সাথে অনেক বড় একটা মিল বের হল। আমরা দুজনেই হুমায়ুন আহমেদের লেখার ভক্ত। কাজেই একবার কথার ফুলঝুরি শুরু হলে আর থামত না। সন্ধারাতে শুরু হয়ে কখনও কখনও মাঝ রাতে গিয়ে ঠেকত। রাহাত এর মধ্যে বাগড়া দিয়ে বলত, হয়েছে, থামো এবার, ঘুমাতে দাও। কাল সকালে সিটি আছে।

আমি, তপু আর রাহাত।

মাঝে মাঝে আমরা হাঁটতে বের হতাম। সবুজের খোঁজে। ইট কাঠ পাথরের এই শহরে সবুজ যে নাই তা না। তবে ধুলার মোটা আস্তরণে সবুজ দেখতে কারও ভালো লাগার কথা নয়। তপু বলত, ভাইয়া চলেন, আজ ওদিকটায় যাই। এতদিন হল এসেছি ওদিকটায় যাওয়া হয় নি খুব একটা।

ডাল ভাজা হাতে নিয়ে আমরা বের হতাম। মুখে গল্প চলত। জীবনের গল্প। তপু মানুষের জীবন খুব সুন্দরভাবে অবলোকন করত। যে জিনিসগুলো আমাদের চোখে ধরা পড়ত না, সেগুলোর খুব সূক্ষ্মভাবে সে বর্ণনা করত। এই শহরের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষের জীবনের গল্প জানা ছিল তার। কেমনে জানি সে তাদের জীবনের কথা গুলো বের করে নিয়ে আসত। শুনে মনে হত সে তাদেরই একজন।

ওই যে ভাইয়া, রোজ মধ্যরাতে ময়লা নিতে আসত যে লোকটা সিটি কর্পোরেশন এর গাড়িতে করে। হ্যাঁ, হ্যাঁ ঐ হৃষ্টপুষ্ট লোকটা। সে গত সপ্তাহে মারা গেছে। স্ট্রোক করে। প্রচুর ধূমপান করত লোকটা। কয়েকদিন ধরেই খেয়াল করছিলাম নতুন একটা লোক এসেছে। ওকে জিজ্ঞেস করতেই বলল। আরও মজার ব্যাপার হল, সে মারা যাবার পর দিনই তার যা কিছু ছিল তা নিয়ে তার বউ লাপাত্তা। পুলিশ এখন তার বউকে সন্দেহ করছে।

আমরা শুনতাম। অনেক ধরণের গল্প। মাঝে মাঝে জীবন দর্শন নিয়েও কথা হত। ও বলত, হিমু হতে পারলে মন্দ হত না। নির্ভাবনায় নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করা যেত। খালি পায়ে হেঁটে মাটির স্বাদ আস্বাদন করা যেত। যদিও এখানে পিচের স্বাদ ছাড়া কিছুই নাই।

আমি বলতাম, তুমি তো অলরেডি হিমু হয়ে গেছো।

সে বলত, কি যে বলেন, আমি হলাম হিমুর উল্টোপিঠ, মুহি। কোন কিছুর মায়া ছাড়তে পারি না। তাই তো ছুটি হলেই বাড়ির দিকে ছুট লাগাই। মাকে দেখতে, আমার চির পরিচিত প্রকৃতিকে দেখতে। হিমু রাতে হাঁটাহাঁটি করে। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না। অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে।

তপুর রাতজাগার অভ্যাস। কখনো পড়াশোনা করে, কখনো বা লেখালেখি। ফার্স্ট ক্লাস লেখা। ওর লেখা গুলো পড়তে ভালো লাগত। মাঝে মাঝেই বলতাম, পত্রিকায় লিখ। অথবা বই বের করে ফেল। রাহাতের পরিচিত এক প্রকাশনী আছে। কম টাকায় ছাপিয়ে দিবে।

তপু মাথা নাড়ে। সে নিজের জন্য লেখে। আমি হলাম তার একমাত্র পাঠক।

ওর লেখা পড়লে জীবন সম্পর্কে গভীর বোধ চলে আসে। জীবনকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখা। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের চোখে দেখা। টিউশনিতে যাওয়া আসার সময় এসব জীবনবোধ সংগ্রহ করে সে। মানুষের কাছে জীবনের অর্থ কি? কেন মানুষ বাঁচতে চায়? বাড়িঘর কিছুই নাই অথচ কোন কিছু ছাড়া কিভাবে ফুটপাথের উপর জীবন পার করে দিচ্ছে।

এগুলো যে শুধু ওর লেখা ছিল তা নয়। ও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজত। জীবনের অর্থ কি, লক্ষ্য কি? মানুষ কি পেলে সুখী হবে এসব আর কি। কখনো কখনো বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসায় যেত, এমনকি মন্দিরও বাদ যেত না। কিছু একটা খুঁজে বেড়াত।

এসব কিছুর পরেও রেজাল্ট অনেক ভালো ছিল তপুর। দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত সে সেকেন্ড ছিল ক্লাসের মধ্যে। সবাই বলত, ও টিচার হয়ে যাবে। শুনে মুচকি হাসত সে। বলত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার মধ্যে কোন তৃপ্তি নাই আমার। তবে শিক্ষক হবার ইচ্ছা আছে। পাশ করে গ্রামে চলে যাব। ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়াব। ছোট বাচ্চাদের যে সাঁচে গড়ে তোলা যায়, সারাজীবন তার প্রভাব থেকে যায়। অল্প কিছু ছাত্র ছাত্রী থাকবে আমার। মাঝে মাঝে ওদের নিয়ে নদীর ধারে হাঁটতে বের হব। ওদেরকে নিয়ে পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্না দেখতে বের হব, দেখাব অমাবশ্যার স্বরূপ। জীবনকে বুঝতে শিখাব।

বলতে বলতে চোখ দুটো বড় হয়ে যেত ওর। বড় আকুলতা সেখানে। তাই কি সে এত ছোটাছুটি করে জীবনের অর্থ খুঁজে? দর্শন, সাহিত্য কিছু বাদ রাখে না।

অনার্স শেষ হবে হবে করছে আমাদের। মাথায় হাত দিয়ে থিসিসের জন্য সায়েন্টিফিক পেপার পড়ছি। প্রফেসর খুব যন্ত্রণা করছেন। ঠিক সেরকম সময়ে একদিন তপু বলে উঠল, ভাইয়া হল ছেড়ে দিব ভাবতেছি।

কথাটা শুনেই বুকে একটা মোচর দিয়ে উঠল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল, আপনাদের বলা হয় নি, সামনে বিয়ে করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। হ্যাঁ রেণুকেই বিয়ে করছি। বিয়ের আগেই বাসা নিচ্ছি। মাকে নিয়ে আসব। বাড়িতে একা থাকতে দিব না আর। কলাবাগানে একটা বাসা পছন্দ করে এসেছি সেদিন।

কদিন পরে বইপত্র বেডিং নিয়ে হল ছেড়ে গেল তপু। ওর বিয়েতেও গেলাম। অনুষ্ঠান কিছু না। গোটাকয়েক মানুষ আমরা।

এরপর মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে দেখা হত। দেখা হলেই, তার চিরপরিচিত হাসি দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করত। খুব বেশী সময় দিতে পারত না। ব্যস্ততা বেড়েছে এখন।

হঠাত একদিন ফোন দিয়ে বলল, মা অসুস্থ। মনে হয় বাঁচবেন না। তাড়াতাড়ি করে দেখতে গেলাম। ডাক্তার খুব একটা আশা দেখাতে পারলেন না।

মা মারা যাওয়ার পরে তপু কেমন যেন একটু বদলে গেলো। চোখের নিচে কালি, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাঝে একদিন রেণু ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করল। কথা বলে দেখব বলে আশ্বাস দিলাম।

আমার নিজেরও ব্যস্ততা বেড়েছে। একটা বেসরকারি কোম্পানিতে ঢুকেছি। সাথে বিসিএসের পড়াও পড়ছি।

এর মাঝেই একদিন শুক্রবার বিকেলে টিএসসির সামনে তপুকে ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি? এরকম ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছ কেন? রেণুর কি খবর?

তপু বলল, রেণুর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে। মা মারা যাবার পর জীবন নিয়ে অনেক ভেবেছি। এখনো ভাবছি। আল্লাহ তাআলা মানুষকে কত রকমের জীবন দিয়েছেন, দিয়েছেন মৃত্যু। কত সুশৃঙ্খল পৃথিবী! মানুষ আসে, আবার হারিয়েও যায়। এসব নিয়ে লিখছি। আসলে জীবনটাকে ঢেলে সাজাবো ভাবছি।

জিজ্ঞেস করলাম, নরমাল জীবনযাপনে সমস্যা কি? আর দশজনের মত!

সে বলল, নরমাল জীবনই তো চাচ্ছি। তবে চাচ্ছি জীবনটা অর্থবহ হোক। মনে আসুক প্রশান্তি। এসব নিয়ে রেণুর সাথে বনিবনা হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তা ডিভোর্স এ গিয়ে ঠেকেছে এই আর কি।

আমি বললাম, দোষ তো তোমার! ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছ, রেজাল্টটা হোক, চাকুরি করো। নিজের অর্জিত জ্ঞানটা তো কাজে লাগাবে নাকি? রেজাল্টটাতো আগের মতই আছে বলে শুনেছি।

তপু শুকনো মুখে বলল, দেখি।

এরপর তপুর সাথে আর দেখা হয় নি। ভার্সিটিতে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি, ওর ঐ বাসাতেও গেছি। বাসা ছেড়ে দিয়েছে। ওর বন্ধুরাও কেউ খোঁজ বলতে পারে নি। রেজাল্টশিটও নাকি তুলতে আসে নি।

তপু হারিয়ে যাবার পর আমার মধ্যেও কেন জানি একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। বুঝলাম তপুর রোগে ধরেছে। মাঝে মাঝে অফিস থেকে আগেই বের হতাম। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতাম। বিশেষ করে তপু যে জায়গাগুলোতে বেশী ঘুরত সেদিকে যেতাম। যদি হঠাত দেখা হয়ে যায়। আর সে বাঁকা দাঁতের হাসি হেসে বলে, আরে ভাইয়া, এদিকে আপনি। চলেন চা খাই। এই নিন আমার লেখা গুলো। ওটা আসলে একটা গবেষণার অংশ ছিল। জীবন নিয়ে গবেষণা।

এরপর অনেক সময় চলে গিয়েছে। তপুকে ভুলে গেছিলাম প্রায়। কিন্তু ওর রোগটা ছাড়ে নি আমাকে। ওর সেই প্রশ্নগুলো আমাকে ব্যাপক যন্ত্রণা দিত, জীবনের লক্ষ্য কি তোমার? কিসের পিছনে ছুটছ?

এরপর সরকারি অফিসার হিসেবে দুই জায়গায় পোস্টিং পেয়েছিলাম। প্রথমটা ঢাকায়, পরেরটা দক্ষিণবঙ্গে। এবার অবশ্য রাঙ্গামাটিতে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। আগেই বুঝতে পেরেছিলাম এবার শাস্তিমূলক বদলি পেতে যাচ্ছি।

পাহাড়ি এলাকা। বিশাল এলাকার দায়িত্ব। ফ্যামিলি রেখে এসেছি ঢাকায়। আমার মধ্যে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া! অনেক দিন ধরেই আবহাওয়া পরিবর্তন চাচ্ছিলাম। আবার ফ্যামিলি ছেড়ে এসেও শান্তি পাচ্ছিলাম না।

এলাকাটা বিশাল হলেও, মানুষজন একেবারেই কম। বাড়িঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় বাজার। দুর্গম এসব এলাকায় স্কুল একেবারেই হাতে গোনা।

সেদিন বিকালে নৌকা নিয়ে শহর ছেড়ে বেরিয়েছি। আমার এলাকার শেষ দিকটায় যাব। ঐদিকটায় খুব একটা যাওয়া হয় না।

নৌকা থেকে নেমে কিছুদূর হাঁটতেই ঐ পাহাড়ের উপর একটা স্কুলের মত মনে হল। একটু অবাকই হলাম। দুর থেকে অনেক সুন্দর লাগছিল। এর থেকে বড় ব্যাপার হল আঙ্গিনায় দেখতে পাওয়া এক যুবককে। হাঁটাহাঁটি করছিল। মুখটা স্পষ্ট দেখতে না পেলেও হাটাটা পরিচিত লাগল। বুকের মাঝখানে কেমন জানি একটা মোচর দিয়ে উঠল।

গাইডকে সংগে নিয়ে স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছলাম। স্কুল না, এতিমখানা। স্কুলের আদলে গড়া । ইসলামিক স্কুল! আর সামনে তপু না!

হ্যাঁ! তপু! আমাদের রুমমেট।

ওকে এভাবে দেখতে পাব বলে ভাবি নি। মুখ ভর্তি দাড়ি। গায়ে জোব্বা! মাথায় টুপি।

আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এল। ভাবখানা এমন যেন আমার এখানে আসার কথা আগেই জানত।

স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন ভাইয়া?

ওকে দেখে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি আমি। উত্তর না দিয়ে অনেকটা স্বার্থপরের মত জিজ্ঞেস করলাম, পেয়েছ খুঁজে? লেখা শেষ করেছ?

জিজ্ঞেস করল, সময় আছে? থেকে যান! পূর্ণিমা রাত আজ। গল্প শুনাব আপনাকে। জীবনের গল্প।

আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম। অদ্ভুত এক বাসস্থান এই পৃথিবী। কত রকমের মানুষ। কত অদল বদল ঘটে এখানে মানুষের জীবনে। সেই তপু, আজ এই তপু।

আমি ওর পিছনে পিছনে এগোলাম। হ্যাঁ! গল্প শুনব। দেখব ওর সেই লেখা। শেষটা জানার খুব ইচ্ছা আমার। হয়ত সেজন্যই ওকে খুঁজে বেরিয়েছি। প্রকৃতির সাথে আপন হয়ে জ্যোৎস্না আলোয় শুনব তপুর কথা। কে জানে, হয়ত ফিরব আমার বাকি জীবন অর্থবহ কাটানোর রসদ নিয়ে।

পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মাঝে মাঝে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। কিছু লিখি। তারপর আবার মুছে ফেলি। লেখা আর মুছে ফেলার মাঝে কিছু থেকে যায়। সেগুলোর জন্যই এখানে আসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back To Top