গল্পগুলো যখনই পড়তে যাই, তখন অন্যরকম লাগে। কি সুন্দর, প্রাণবন্ত! প্রতিটা গল্পের একটা কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে। তাকে ঘিরেই গল্পটা সামনে এগোতে থাকে। গল্পের শুরু হয় কেন্দ্রীয় চরিত্রের শুরু দিয়ে, গল্পগুলোর শেষ হয় কেন্দ্রীয় চরিত্রের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে।
গল্পগুলো প্রথমে অদ্ভুত লাগতে পারে! পড়তে গিয়ে পাঠক ধোঁকায় পড়তে পারেন। মাথা গুলিয়ে যেতে পারে। কারণ গল্পগুলো বিচ্ছিন্ন নয়, একটার সাথে আরেকটা গভীরভাবে প্রোথিত। কাজেই একটা গল্প শুরু করে অন্যটাতে ঢুকে যাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার, অসাধারণ কেউ ছাড়া এই ব্যাপারটা উপেক্ষা করার মত নয়।
গল্পের দৈর্ঘ্য সমান নয়। কোনটা শুরু হয়ে কয়েক লাইন লিখেই শেষ হয়েছে। কোনটাতে আঁকিবুঁকি চলেছে কয়েক পাতা জুড়ে, কোনটা আবার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এমনভাবে চলেছে যেন শেষ হবার নয়। তবে একসময় গিয়ে কিন্তু শেষ হয়েছে।
সমাপ্তি বিষয়টা সবগুলো গল্পের ক্ষেত্রে কমন। এটাও আবার অদ্ভুত ধরণের। আমরা সাধারণত যে গল্প গুলো পড়ি সেগুলোর মূল উদ্দেশ্য অর্জনের পর শেষ হয়। তাছাড়া তাকে গল্প বলি না আমরা। অথচ এই গল্পগুলোর শেষের নিশ্চয়তা থাকলেও সেটা ঠিক কোন জায়গাটায় গিয়ে শেষ হবে সেটা গল্পের নায়ক যেমন জানে না, তেমনি জানে না ওই গল্পের অন্য কোন চরিত্রও। কারণ প্রত্যেক চরিত্রই তার নিজের গল্পের নায়ক।
আগেই বলেছি, এখানে বিচ্ছিন্ন কোন গল্প নেই। কাজেই কোন গল্প যখন শেষ হয়ে যায় তখন অনেকগুলো গল্পে তার প্রভাব পরে। তবে অন্যগুলো থেমে যায় না। এই গল্পটার সারাংশ অন্য গল্পের নায়ক নায়িকাদের স্মৃতিতে থেকে যায়। তবে এই স্মৃতি ধ্রুবক না, ক্ষীয়মাণ। কালের স্রোতে একসময়ের জীবন্ত গল্প গুলো হারিয়ে যায়।
মাঝে মাঝে আমরা গল্পগুলো পড়ার চেষ্টা করি। নিজের সীমাবদ্ধতার কারণে হয়ত একটা গল্পের অল্প কিছু ঘটনার সাথে পরিচিতি ঘটে। তাতেই আমরা বিস্মিত হই। কত বৈচিত্র্যময় গল্প! কোনটা গ্রামের কোন এক ক্ষুদ্র কোণে শুরু হয়ে হয়ত ওই গ্রামটাই অতিক্রম করতে পারে নি। কোনটা আবার গ্রামে শুরু হয়ে শহরে শেষ হয়েছে। কোনটা আবার দেশ বিদেশ ভ্রমণ করেছে। কোন গল্পে দারিদ্র্যতার কষাঘাতকেই উপজীব্য মনে হয়, কোনটাতে বিলাসিতা। কোন গল্প ঘুরপাক খেয়েছে আলিশান বাড়িতে, কোনটা ফুটপাতে।
গল্পের নায়ক/ নায়িকাদের মধ্যেও আমরা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করি। কোন গল্পের নায়ক নিজেকে প্রস্ফুটিত করতে পারে নি সুযোগের অভাবে, কেউ আবার নিজেকে মেলে ধরেছে। কেউবা অন্য গল্পগুলো সাজাতে ব্যস্ত, কেউ আবার নিজেকে ব্যর্থতায় আবৃত এক কফিন ভেবে জীবন শেষ করেছে।
গল্পগুলো পড়তে পড়তে আমাদের মনেও প্রশ্ন ওঠে, এই গল্পগুলোর মধ্যে সেরা গল্প কোনটা? কিসের মাপকাঠিতে আমরা বিচার করব এগুলোকে! এগুলো যাচাই বাছাই করার সামর্থ্য কি আমাদের আছে?
এর উত্তর হল, আমাদের কাছে ওই সামর্থ্য নেই। আমরা কোন গল্পের সব ঘটনা সব দিক দিয়ে পড়ে শেষ করতে পারি না। গল্পের জীবন্ত নায়কদের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি থাকলেও গল্পের অন্যান্য উপাদান তার নিয়ন্ত্রণে নেই। গল্পটার পরিবেশ শহুরে হবে না গ্রাম্য হবে, শিক্ষিত হবে নাকি অশিক্ষিত হবে, ধনী হবে না গরিব হবে, বুদ্ধিমান হবে না বোকা হবে, গল্পের কোন মুহূর্তে তার আশেপাশের পরিবেশ, সহায়ক শক্তি ইত্যাদি কোনকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে নাই। কাজেই কোন নায়ক যদি দাবি করে সে সফল কিংব ব্যর্থ, এটা একটা নিষ্ফল দাবি। সে তার চারপাশের উপাদান গুলোর অবস্থা বুঝে, তাকে যে বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য উপকরণ দেয়া হয়েছে সেগুলো কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করতে পারে, সফলতা পেতে পারে, কিন্তু সেই সফলতা তার নিজের অর্জিত এই দাবি করতে পারে না।
আমরা এই গল্পগুলোর বিচার বিশ্লেষণ করতে পারি না, কারণ আমরাও এই গল্পগুলোর কোন কোনটাতে চরিত্র হিসেবে আছি। এর মধ্যে কেবল একটা গল্পেই আমরা কেন্দ্রীয় চরিত্র, বাকিগুলোতে পার্শ্ব চরিত্র মাত্র। আমাদের গল্পগুলো এগিয়ে যায়, কিন্তু আমরা সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাই না। আমরা কেবল আমাদের আশেপাশের যে সেট আপ আছে সেগুলোর সাথে ইন্টারেকশন করি মাত্র।
তবে আমাদের গল্পগুলোরও একজন লেখক আছেন। তিনি অন্য সকল লেখকদের মত নন, তিনি এসব গল্প থেকে পবিত্র। তিনি কোন স্থান বা সময় দ্বারা আবদ্ধ নন, তিনি স্থান, কাল সময় থেকেও পবিত্র। তিনিই আল্লাহ তাআলা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের গল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান দিয়েছেন। আমাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। বুদ্ধিমত্তা দিয়েছেন। অথচ এই সাময়িক জীবনের সীমিত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কত কেন্দ্রীয় চরিত্র আল্লাহ তাআলাকে অস্বীকার করছে, নিজের গল্পের সাথে আরও হাজার হাজার গল্পের পরিবেশ দুষিত করছে।
আল্লাহ তাআলা সবাইকেই তার গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়েছেন, দিয়েছেন ইচ্ছাশক্তি। এছাড়া তিনি প্রত্যেক গল্পের উদ্দেশ্য জানিয়েছেন, দিয়েছেন গাইডলাইন। কি করতে পারবে, আর কি পারবেনা তাও জানিয়েছেন। তিনি এদের প্রত্যেকের প্রতি মুহূর্তের প্রত্যেক পদক্ষেপের জন্য জবাবদিহিতা করবেন। ভালো কাজের জন্য রেখেছেন পুরস্কার, আর বদ কাজের জন্য রয়েছে উপযুক্ত শাস্তি।
আমাদের গল্পগুলো একদিন শেষ হয়ে যাবে তা আমরা সবাই জানি এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। এটাই বাস্তবতা। অস্বীকার করেও লাভ নাই। আমাদের গল্পগুলো শেষ হয়ে যাওয়া মানে কেবল অন্য চরিত্রের মস্তিষ্কে স্মৃতি হিসেবে জায়গা দখল করবে এমন নয়। এই গল্পের ইন্টারেকশনের উপর ভিত্তি করে সাথে সাথে আরেক গল্পের শুরু হবে। সেই গল্প হবে অনন্তকালের। সেই গল্প হবে অন্যরকম, তবে তার উপাদানসমুহ আল্লাহ তায়ালা ঠিক করার সময় বিবেচনা করবেন এই গল্পে আমাদের চিন্তা, কথা, কাজের ধরণ।
আমরা সবাই চাই আমাদের এই গল্পের শেষটা সুন্দর হোক। কিন্তু শয়তান এবং নফসের প্ররোচনায়, পরিবেশের প্রভাবে আমরা ভুলে যাই আমাদের গল্পের শেষের কথা। আমরা ভাবি আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে নিয়ে অন্যান্য সার্থক গল্পের মত ধীরে সুস্থে আমরা গল্প শেষ করব। আমাদের এই বোধ হারিয়ে যায় যে আমরা গল্পের চরিত্র মাত্র, লেখক নই। কখন কোন মুহূর্তে গল্প শেষ হয়ে যাবে সেটা আমরা বলতে পারি না।
কাজেই আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। গল্পের যেকোন পৃষ্ঠার যেকোন লাইনে হঠাত করেও যদি শেষ হয়ে যায়, তবুও যেন গল্প পূর্ণতা পায়। আর গল্প পূর্ণতা পাবে তখনি, যখন ওপারের গল্পটা হবে সুন্দর এবং শাশ্বত!
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেকের গল্পের সুন্দর পরিসমাপ্তি দিন। আমাদের সবার ওপারের জীবনটাকে শান্তিময় করে দিন। আর বিন্দুমাত্র ঈমান নিয়ে যাদের গল্প শেষ হয়ে গেছে, তাদেরকে কর্মগুলোকে ক্ষমাসুন্দরভাবে দেখে কবুল করে নিন। আমিন।