আমরা কিরকম বিজ্ঞানমনস্ক ব্রেনওয়াশড হই সেটার একটা নমুনা শোনাই। তখন হয়ত ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়ি। সেদিন প্রচুর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সাথে ছিল বজ্রপাত। তো বজ্রপাতের আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই জনৈক ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লালাহ পড়েন। বিপদে পড়লে আমরা আল্লাহর স্মরণ করি এটাই স্বাভাবিক। তো ওনার ঐ কালিমা পড়াটা আমার কাছে অত্যন্ত ব্যাকডেটেড লাগে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকায়, আর মেঘের যে চার্জ জমা হয় তা মাটিতে নেমে আসে বলেই বজ্রপাত হয়। এই জ্ঞান আমি অর্জন করেছি। এখানে কালিমা পড়ার তো কিছু নেই। এই ছিল ওই সময়ে আমার চিন্তাভাবনা।
অথচ স্কুলে ইসলাম শিক্ষা পড়েছি। বাড়িতে শিক্ষক ডেকে আমাদের কুরআন পড়া শেখানো হয়েছে। কিন্তু এসব জ্ঞান আমার সদ্য অর্জিত বিজ্ঞানকে টেক্কা দিতে পারে নি। ওই সময় মাথায় এটা আসে নি যে বজ্রপাতকে ব্যাখ্যা করতে পারলেই আর বজ্রনিরোধক বস্তু লাগালেই যে তা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নিশ্চিত ঠেকাতে পারব এটা ভাবার কারণ নাই। এসবের সৃষ্টিকর্তার স্মরণ যে বিজ্ঞানের বিরোধী না বরং একজন মুসলিম হিসেবে এটাই কাম্য।
আমরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ ব্যাবহার করে বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণা করছি। আবার অতি ক্ষুদ্র কণাকে গাইড করে জটিল জটিল প্রযুক্তি তৈরি করছি। পদার্থ বিজ্ঞান থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। অনেক সময় আমাদের পুরাতন তত্ত্ব গুলো নব আবিষ্কৃত বিষয় ব্যাখ্যা করতে পারছে না। আমরা নতুন তত্ত্ব দিচ্ছি কিংবা পুরনোটাতেই কারেকশন যুক্ত করছি। জন্ম দিচ্ছি নতুন নতুন উদ্ভাবন আর প্রযুক্তির।
এখানে বলে রাখা ভালো আমরা কোন কিছু শূন্য থেকে সৃষ্টি করছি না। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সেটাকে আরও সূক্ষ্মভাবে বোঝার চেষ্টা করছি, সেগুলোকে রূপান্তর করে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছি। আর আমরা যা কিছু তৈরি করছি, ব্যবহার করছি এ সব কিছুরই সীমাবদ্ধতা আছে। আমরা কেবল আমাদের সীমাগুলিকে সংকুচিত বা প্রসারিত করতে পারি, সেটাকে অসীম করে দিতে পারি না। আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে জটিল রোগ নিরাময় করতে পারি, মানুষকে রোগমুক্ত অমর করতে পারি না, মৃত্যুকে জয় করতে পারি না।
এ বিশ্বজগতে যা কিছু আছে সব কিছুই আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। আমরা তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি মাত্র। বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানেই স্রষ্টাকে অস্বীকার করা নয়, বরং তাঁর সৃষ্টির সূক্ষ্মতা, জটিলতার অনুধাবন করে আল্লাহ তাআলার প্রতি অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আসা। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বার বার তাঁর সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন নিদর্শনের দিকে ইঙ্গিত করে আমাদের বুদ্ধি খাটাতে, চিন্তাভাবনা করতে বলে দিয়েছেন।
যে বা যারা বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে স্রষ্টার অস্বীকারের কাজে লাগাতে চায়, তাদেরকে আমার মনে হয় সেই ব্যক্তির মত যে চোখ বন্ধ করে বলে যে তাঁর সামনে কিছু নেই। মানুষের ফিতরাত বা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য স্রষ্টাকে অস্বীকার করা নয়, বরং তাকে অনুভব করা।
এখানে আরেকটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে, অনেক সময় বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে ধর্মীয় চর্চার বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। যেমন – আমরা এখন মঙ্গলে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছি, আর হুজুররা বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজছে। কিংবা এ বিজ্ঞানের যুগে পর্দায় মহিলাদের আটকে রাখা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা কোন ডাক্তার যদি এখন আমাকে বলে আমরা যখন মানুষের জটিল রোগ ভালো করছি, তখন তোমরা এটা ওটা করছ সেটা কি রিলিভেন্ট হবে? সমাজবিজ্ঞানীর কাজ সমাজ নিয়ে, ডাক্তারের কাজ ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারের কাজ ইঞ্জিনিয়ারিং, যে মংগলের যন্ত্র বানাচ্ছে তাঁর কাজই ওটা, মুফতির কাজ ফতোয়া দেয়া। বিজ্ঞান আরও হাজারগুণ এগিয়ে গেলেও মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন মানুষের মধ্যকার বেসিক জিনিসগুলো যেমন- খাবার খাওয়া, সামাজিক সম্পর্ক, বিরোধ ইত্যাদি থাকবেই। আর এগুলো থাকবে বলেই মানুষের জীবনব্যাবস্থাও থাকবে। সেটা হতে পারে কৃত্রিম জীবনব্যাবস্থা যেমন – বিভিন্ন বাদ বা তন্ত্র, আবার হতে পারে স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত ইসলামী জীবনব্যবস্থা।
সারকথা হল বিজ্ঞানের অগ্রগতি না স্রষ্টাকে বাতিল করে, না ইসলামকে। অন্ধ বিজ্ঞান্মনস্ক না হয়ে জ্ঞান বিজ্ঞানের কোন শাখায় কিছু অবদান যেমন রাখতে পারি, তেমনি সেটা না করতে পারলেও সমাজ জীবনকে সুন্দর করায় অবদান রাখতে পারি। একজন বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে কৃষক, শ্রমিক, কিংবা শিশু থেকে বৃদ্ধ সবারই জীবনের মূল্য আছে। বিজ্ঞানে অবদান রাখতে না পারলেই জীবন মূল্যহীন হয়ে যাবে না। সবার জীবনের যেমন শুরু আছে তেমনি শেষও আছে। কিন্তু এই শেষটা অনির্দিষ্ট।
জ্ঞানের যেটুকুই আমরা অর্জন করি না কেন সেটা মৃত্যুর সাথে সাথে আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাবে। শিশু অবস্থায় আমরা থাকি জ্ঞানের দিক দিয়ে মূর্খ, মরার সময়েও তাই হয়ে যাই। মাঝের কয়দিন আমাদের অহংকারের শেষ থাকে না। আমরা আমাদের শিশু অবস্থার কথা ভুলে যাই, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার কথা ভুলে যাই, ভুলে থাকি মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের শেষের কথা। আমাদের জীবন কাটুক আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত ফ্রেমে, এ জীবনের শেষটা হোক সুন্দর এবং অর্থবহ আর ওপারের অসীম জীবনটা কাটুক জান্নাতে।
—
আল্লাহ তাআলার তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ), তাহলিল (আলহামদুলিল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) এগুলো হেলাফেলার বিষয় নয়। অনেক সময় আমরা এগুলোকে হেলাফেলা করে দ্বীনের এডভান্স বিষয়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। এগুলো পাঠ করা সেকেলে নয়, বরং এটাও আল্লাহ তাআলার একটা চাওয়া। আমরা তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করব, তাঁর প্রশংসা করব এটাই তিনি চান। এগুলো পাঠে সবারই অভ্যস্ত হওয়া উচিত, বিশেষ করে – ফরয নামায শেষে, সকাল – সন্ধ্যায়। একটা হাদিস বলে শেষ করছি –
আবূ যার্র (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে প্রত্যেকের প্রত্যেক (হাড়ের) জোড়ের পক্ষ থেকে প্রাত্যহিক (প্রদেয়) সাদকাহ রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ বলা) সাদকাহ, প্রত্যেক তাহমীদ (আলহামদু লিল্লাহ বলা) সাদকাহ, প্রত্যেক তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা) সাদকাহ, প্রত্যেক তাকবীর (আল্লাহু আকবার বলা) সাদকাহ এবং ভাল কাজের আদেশ প্রদান ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা সাদকাহ। এ সব কাজের পরিবর্তে চাশতের দু’রাক্আত নামায যথেষ্ট হবে।’’[১]
[১] মুসলিম ৭২০, আবূ দাউদ ১২৮৫ / ১২৮৬