আরও একটা সকাল হয়। জেগে উঠি। যেন এক মৃত্যু থেকে ফিরে আসি। প্রতিদিনই এমন হয়, সকাল হয় বিকাল হয়, রাত হয়। জেগে উঠি, ঘুমাই। আর কত!
প্রতিদিন উঠে জিজ্ঞেস করি, দশ হাজার দিন মিলতে কয়দিন বাকি আছে? দশ – বারো দিন! কি আশ্চর্য! এত কমে গেলো কিভাবে?
কোথায় আমি? শহরে নাকি গ্রামে? কি পার্থক্য তাতে!
কখনো যেন পাশের নলকূপ পাড় থেকে ঝগড়ার শব্দ ভেসে আসে। দুই মহিলার কণ্ঠের! একজনেরটা জোরে শোনা যায়, আরেকজনের আস্তে! প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া লাগে। এটা ওদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ! স্বল্প আয়, টানাপড়েন, ছোট ছোট স্বপ্ন, আপাত সুন্দর জীবন। টিপিক্যাল নিম্নমধ্যবিত্ত জীবন। নিজের জন্য, সন্তানের জন্য ছোট ছোট স্বপ্ন। তারপর সন্তানেরা বড় হবে! বিয়ে করবে! ছেলে আর ছেলের বউয়ের সাথে শাশুড়ির ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়ায় একসময় তারা আলাদা হবে! এভাবে স্বপ্নরা বংশবৃদ্ধি করবে!
গ্রামের জীবনও এমনই। বাহিরের হাঁসফাঁস নেই, বাহ্যিক প্রভাবক নেই। হঠাত কোন অচেনা মুখ দেখা গেলে ডজনখানেক চোখ কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে থাকবে। কোন বাড়িতে যাবে, কার আত্মীয় এসব অনুমান করার চেষ্টা করবে অনেকে। কেউ আবার তার মতলব নিয়ে সংশয়ে ভুগবে। মসজিদ থেকে ফিরতে থাকা গ্রামেরই কোন মুসল্লি অনুমানের ধার না ধেরে জিজ্ঞেস করেই বসবে।
পাঞ্জাবি ঘাড়ে করে ফেরা মুসল্লি চাচা দ্রুতই তার কাজে বের হবে আবার। সামনের মাসে গরুটা হাঁটে তুলতে হবে। ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলে ভালো হত। কি আর করা! টিনের চালা ফুটো হয়ে যাচ্ছে। দ্রুতই বদলাতে না পারলে সামনের বর্ষায় আবার না কোন বিপদে পরা যায়! মেজো মেয়েটাও বিয়ের বয়সী হয়ে যাচ্ছে। এসব নিয়েও ভাববার প্রয়োজন আছে, মনে করিয়ে দিবেন মুসল্লি চাচার বউ।
গ্রামের মোড়ে টঙ্গের দোকানে আলাপ বসবে। মেম্বার চেয়ারম্যান কিংবা অন্য কোন বিষয়ে! অথবা কারও জমি নিয়ে বিরোধ। কাছেই কিছু দুরে জটলা! তাস কিংবা লুডু নিয়ে বসেছে বোধহয়।
এই ছিল তাদের জীবন। তবে এখন সবই দ্রুত হয়ে গেছে। তারাও জাতীয় ইস্যুতে তর্ক করে। ছেলেপেলেরা গেম খেলে মোবাইলে! দূর নাম না জানা কোন অঞ্চলের কোন খেলা নিয়ে কেউ বাজি ধরে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে এই তাদের জীবন! আধুনিকতার ছোঁয়া লাগা চিরন্তন বুনিয়াদ ভিত্তিক এক ছোট্ট জীবন। যেখানে ছোট ছোট সুখ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ঘিরে এখনো জীবন ঘুরপাক খায়।
এখানেই বা আলাদা কেমনে!
এইত সেদিন ফুটপাতের উপরে চা-সিগারেটের দোকানের পাশে দুইজনের মধ্যে বাহাস লেগে গেল! মুহুরতেই টান টান উত্তেজনা। লোকজনও দুই ভাগে ভাগ হল। কথার ফুলঝুরিতে তারা প্রমাণ করতে লাগল কার দোষে দেশের এই অবস্থা!
পাশের বিল্ডিঙের পঞ্চম তলায় শহুরে মধ্যবিত্তদের মাঝেও একই রকম আড্ডা! এই ইস্যু, ওই ইস্যু! চুলচেরা বিশ্লেষণ!
অফিস শেষে এরা বাসে উঠে পড়ে। কখনো জটে আটকা পড়ে, কখনো তাড়াতাড়ি ফিরে নিজের সৌভাগ্যের দিকে চায়! যাক! তিন বছরের বাচ্চাটা এখনো ঘুমোয় নি! বউয়ের সাথে সামনের ঈদের প্লান করে। মাসশেষে হাতটান পড়ার কারণে কিভাবে আর কয়েকটা দিন চালানো যায় সেই চিন্তাও মাথায় উকি দেয়! গ্রামের জমিজমার মোকদ্দমারও খোঁজ নেয়া দরকার!
এই হল এদের জীবন। এক শহুরে মধ্যবিত্ত জীবন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকা এক জীবন।
আর বাকিদের! কারা? শিল্পপতি, শ্রমিকদের বড় নেতা কিংবা ক্ষমতাসীন মন্ত্রী! প্রকৌশলী কিংবা বিজ্ঞানী!
সবার জীবন একই ধাঁচে গড়া। পার্থক্য সামর্থ্যে, বিলাসিতায়, আলোচনার বিষয়ে কিংবা স্বপ্নে। জীবন তাদের এক ছকে বাঁধা!
ওদের? ওদের আবার কি! সাদা চামড়া, কালো চামড়া! বিলিয়নিয়ার হয়েছে তো কি হয়েছে! সবাই জীবনের এক অমোঘ ছকে বন্দী।
ওই সকালে সবার কোলাহল শুরু হয়। অবশ্য কেউ রাতে দেরীতে শেষ করে, দেরীতে শুরু করে। তাতে কি! দিন যায়, রাত আসে। একটা দিনের হিসেব শেষে নতুন দিনের হিসেব কষে। গতকালের সময়টা গত হয়ে যায়। যেন সময়ের এক স্পাইরাল বৃত্ত!
এমনটাই তো হবে! এটাই তো জীবন! তাই নয় কি?
হ্যাঁ, তাই হবার কথা। তবু কেমন করে যেন দশ হাজার দিন চলে গেল।
হিসেবটা উলটো দিক থেকে শুরু করলে ভালো হত! কিন্তু উলটো হিসেবটা শুরু করব কোথা থেকে! মরার দিন থেকে শুরু, জন্মের দিকে শেষ? কেমন হয়ে গেল না সেটা?
শক্তি, জ্ঞান সামর্থ্য সবকিছু তো তাহলে উঁচু থেকে শূন্যের দিকে এগোবে। মানুষ স্বপ্ন দেখবে কি করে!
মৃত্যুটা জানতে পারলে তো ওপারের হিসাবের ব্যাপারটাও এসে যাবে! তখন এই জীবনের হিসেবের কি হবে! দিবস রজনীর ছকে বাঁধা সময়টা গুরুত্ব হারাবে না ত!
নাকি আবার মনোযোগ ওপারে চলে যাবে? ঐ হিসাব তো ভুলে থাকা যাবে না! বড় সূক্ষ্ম সেই হিসাব! অনিশ্চয়তার দোহাই দিয়েই তো সেটা ভুলে থাকি আমরা!
দশ হাজার, বিশ হাজার, কিংবা ত্রিশ হাজার! এই সকালের আবর্তন একদিন শেষ হয়ে যাবে! মৃত্যুর বুক চিরে স্পাইরাল বৃত্ত ওপারে পাড়ি জমাবে অনন্ত সরলরেখায়!
পথের দুর্গমতা সুগমতা নির্ধারণ করবে এপারের এই সকাল সন্ধ্যা, কিংবা সন্ধ্যা সকাল। দশ, বিশ কিংবা ত্রিশ হাজার সন্ধ্যা সকাল!
—
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলের এপারের জীবনকে ওপারের জন্য উপকারী বানিয়ে দিন! আমিন।